১ হাজার পুরুষকে হিজড়া বানিয়েছেন ভুয়া ডাক্তার
- আপডেট সময় ০৭:১৫:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৪
- / ১৯৮৪ বার পড়া হয়েছে
খুলনার ফুলতলায় একটি ওষুধের দোকান ছিল হাদিউজ্জামান হাদির। একপর্যায়ে তিনি ও কয়েক বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন ফুলতলা সার্জিক্যাল ক্লিনিক।
সেই ক্লিনিকের চিকিৎসক ছিলেন গৌরাঙ্গ চন্দ্র। তিনি সেখানে গোপনে স্বাভাবিক পুরুষের শরীরে অস্ত্রোপচার ও ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) মানুষে পরিণত করতেন। তাঁর সহকারী (কম্পাউন্ডার) হিসেবে কাজ করে এ বিদ্যা শিখে নেন হাদি।
‘গুরু’ খুন হওয়ার পর তিনি নিজেই চিকিৎসক সেজে এই লাইনে নেমে পড়েন। এরপর গত ১২ বছরে তিনি এক হাজারের বেশি পুরুষকে হিজড়ায় রূপান্তর করেছেন।
সম্প্রতি একটি হত্যা মামলার তদন্তের সূত্র ধরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি ও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ঢাকার নিকেতন, আফতাবনগরসহ দেশের অন্তত তিনটি জেলায় ক্লিনিক বা ভাড়া বাসায় তাঁর হিজড়ায় রূপান্তরের অপারেশন থিয়েটার রয়েছে। প্রতিটি অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি গড়ে দেড় লাখ টাকা নিতেন। এখন পর্যন্ত তাঁর ছয় সহযোগীর নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কেউ এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক, কেউ গ্রাম্য চিকিৎসক, আবার কেউ শুধু নামেই চিকিৎসক।
পিবিআই ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা বলেন, ঢাকার আশুলিয়ায় রাকিব হাসান নামে এক যুবককে হত্যার মামলায় জড়িত চম্পা ওরফে স্বপ্না হিজড়াকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি স্বাভাবিক পুরুষ থেকে হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একজন চিকিৎসক তাঁকেসহ অনেককে হিজড়ায় রূপান্তর করেছেন। পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে তখন থেকে সেই চিকিৎসককে খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়। একপর্যায়ে দুই সপ্তাহ আগে যশোর থেকে কথিত চিকিৎসক হাদিউজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বড় একটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক ও ঝুঁকিপূর্ণ এ ধরনের জেন্ডার রূপান্তর প্রক্রিয়ায় জড়িত। তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি বিস্তৃত এ চক্রের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে কাজ করছে পিবিআই।
পার্লারের আড়ালে হিজড়া বানানোর ক্লিনিক
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনার ফুলতলার ক্লিনিকে হিজড়ায় রূপান্তরের হাতেখড়ি হয় হাদির। একপর্যায়ে এ কাজে তাঁর দক্ষতা গড়ে ওঠে। সংশ্লিষ্ট মহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেপ্তারের পর দেখা যায়, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন রূপান্তরকামী মানুষ অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁকে ফোন করেন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি ৪০০ থেকে ৫০০ জন পুরুষকে হিজড়ায় রূপান্তরের কথা স্বীকার করলেও বাস্তবে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বলে পুলিশের ধারণা। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ক্লিনিক বা অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে খুলনার প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁর মালিকানাধীন একটি ক্লিনিক অন্যতম। এ ছাড়া ঢাকা, নড়াইল ও চুয়াডাঙ্গায় তাঁর এ ধরনের অপারেশন থিয়েটার রয়েছে। সেগুলোর কোনোটিতে চুক্তিতে, আবার কোনোটির ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে তিনি গিয়ে অস্ত্রোপচার করেন। এরই মধ্যে ঢাকার নিকেতন ও আফতাবনগরের দুটি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।
নিকেতনের ওই বাসায় গেলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, সেটি একটি বিউটি পার্লার। তবে সেখানে অচেতন করাসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, লোম ও আঁচিল অপসারণের সরঞ্জাম, চিকিৎসকদের ব্যবহৃত আধাশোয়া করে রাখার আরামকেদারা গোছের সেটআপ পাওয়া গেছে। আবার আফতাবনগরের একটি ভাড়া বাসাতেও হরমোন ইনজেকশন, স্যালাইন, অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত ওষুধ ও সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
৯০ ভাগই ভুয়া হিজড়া
তদন্ত সূত্র জানায়, এ ঘটনার অনুসন্ধানে নেমে দেখা যায়, সমাজে হিজড়া হিসেবে পরিচিতদের ৯০ শতাংশই ভুয়া। তাদের মধ্যে তিনটি ধরন রয়েছে। একটি হলো হরমোন ইনজেকশন ও অন্যান্য ওষুধ দিয়ে পুরুষ থেকে নারীস্বভাবে রূপান্তর করা। আরেকটি ধরনের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুরুষের গোপনাঙ্গ বাদ দেওয়া এবং নারীসুলভ শারীরিক গড়ন তৈরি করা হয়। আর কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ও ওষুধ-ইনজেকশন দুই পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে থাকা ১০ শতাংশ হয়তো জন্মগতভাবেই হিজড়া।
প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে রূপান্তর
আশুলিয়ার রাকিব হাসান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই ঢাকা জেলার এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, গ্রেপ্তারের পর চম্পা ওরফে স্বপ্না জানিয়েছেন, তিনি একজন স্বাভাবিক পুরুষ ছিলেন। তাঁর নাম ছিল নওশাদ। তাঁর ১২ বছর বয়সী ছেলে রয়েছে। তবে স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন এবং কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবনযাপন করেন। ওই সময় দেলু হিজড়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দেলু প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক পুরুষ। হিজড়া সেজে নানা অপকর্ম করেন। তিনি নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেন। দেলু জানান, হিজড়া হলে তিনি সহজে অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। সেই সঙ্গে আনন্দ-ফুর্তিতে দিনযাপন করতে পারবেন। তাঁর কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেন।
পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, সাধারণ পুরুষদের নানা রকম প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে হিজড়াদের দলে ভেড়ানো হয়। পরে অস্ত্রোপচার বা ওষুধের মাধ্যমে তাদের হিজড়ায় রূপান্তর করা হয়। একইভাবে দেলুর দলে যোগ দেওয়ার দেড় বছর পর নওশাদ অস্ত্রোপচার করে মেয়ে হিজড়া হন। এটি অপরাধ। কারণ হিজড়া সর্দার তথা গুরুমা বা গুরুবাবারা নিজেদের স্বার্থে সাধারণদের দলে ভেড়ান। তাদের দিয়ে রাস্তায়-পরিবহনে, বাসায় চাঁদা তোলা, অসামাজিক কার্যকলাপ, মাদক কারবারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। এর সুফল ভোগ করেন সর্দাররা। আর রূপান্তরিত হিজড়ারা সামান্য মজুরি পান। দণ্ডবিধি অনুযায়ী, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বা প্রলোভন দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লৈঙ্গিক রূপান্তর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। তা ছাড়া শরীরে বিপরীত লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যের ন্যূনতম উপস্থিতি না থাকার পরও একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ রূপান্তরিত হতে চাইলেই অস্ত্রোপচার করাও নৈতিক হতে পারে না।
রূপান্তরিত হিজড়াদের বিদেশে পাচার
পিবিআই ঢাকা জেলার এসআই সালে ইমরান গত ১ নভেম্বর ধামরাই থানায় এ নিয়ে একটি মামলা করেন। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ধামরাই বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রোম-আমেরিকান হাসপাতাল নামে একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছিল। হাদিউজ্জামান চিকিৎসক পরিচয়ে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ওই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্বাভাবিক পুরুষ-নারীদের হিজড়ায় রূপান্তর শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেলু হিজড়া। এ চক্রটি রূপান্তরিত হিজড়াদের বিদেশে পাচার করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন এবং মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
তাদের কর্মকাণ্ড জানাজানি হলে জনরোষের ভয়ে তারা হাসপাতাল বন্ধ করে পালিয়ে যান। অভিযুক্ত হাদিউজ্জামান আগেও একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।