ঢাকা ১১:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সড়কে বেশি কাজ পাওয়া পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তিনটি নিষিদ্ধ

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০১:৫২:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ মার্চ ২০২৪
  • / ২৯৫ বার পড়া হয়েছে

জালিয়াতিতে জড়িত ২৬টি প্রতিষ্ঠান সড়কের ৯০% কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।সড়কের যে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কাজ পায়, তাদের তিনটিই জালিয়াত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নতুন নতুন ঠিকাদারি কাজ পেতে তারা নথি জাল করেছে বলে উঠে এসেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তদন্তে। দুটির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত চলছে।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, তারা মোট ২৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পেয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ ছয়টিকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

২৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পেয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ৬টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম রেজাউল করিমকে প্রধান করে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গত জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়। ফেব্রুয়ারি থেকে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়।

সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, তাঁরা তদন্ত করে কিছু জালিয়াতি পেয়েছেন, ব্যবস্থাও নিয়েছেন। এটা চলমান প্রক্রিয়া। আরও যাচাই-বাছাই চলছে। যাদেরই জালিয়াতি পাওয়া যাবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, যে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পাওয়া গেছে, তারা সড়কের ৯০ শতাংশের বেশি ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সড়কে কাজ করা ঠিকাদারের মোট সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১০০।

জালিয়াতি চার ধরনের: ১. জাল কর্মসম্পাদন সনদ জমা দেওয়া। অর্থাৎ যে ঠিকাদারি কাজ তারা করেনি, সেগুলোও উল্লেখ করেছে। ২. টাকার অঙ্কে কাজের পরিমাণ বেশি দেখানো। ৩. কাজ শেষ করেছে দেরিতে, কিন্তু দেখিয়েছে তারা যথাসময়ে কাজ করেছে। ৪. আর্থিক সক্ষমতা দেখাতে একটি দরপত্রে একই সনদ বারবার জমা দেওয়া। ৫. যৌথ উদ্যোগের ভুয়া তথ্য জমা দেওয়া।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, যে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পাওয়া গেছে, তারা সড়কের ৯০ শতাংশের বেশি ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সড়কে কাজ করা ঠিকাদারের মোট সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১০০।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), গণপূর্ত অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছে, যার মধ্যে জাল সনদ রয়েছে।

দরপত্রবিষয়ক তথ্যভান্ডার টেন্ডার ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (টিডিএমএস) তথ্য বলছে, বিগত পাঁচ বছরে সওজে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ১০০টি ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। কাজগুলো টাকার অঙ্কে ছোট। সম্মিলিত পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তারা ঢাকা অঞ্চলে বেশি কাজ পেয়েছে।

সড়কের আরেক শীর্ষস্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আগামী জুন পর্যন্ত। বিগত পাঁচ বছরে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ সড়কে প্রায় ১ হাজার ২২০টি ঠিকাদারি কাজ করেছে, যার অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে মেসার্স সালেহ আহমেদ ও জামান এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর এবং মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে আগামী জুন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ঠিকাদার; সবাই বিচারের আওতায় আসবেন। এ জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে।

সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনউল্লাহ নূরী

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সালেহ আহমেদের মালিক সালেহ আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান ভুল করেনি। কয়েকটি কাজে আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অংশ নিয়েছিলেন। আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনোর নথিপত্রে সমস্যা আছে। এর জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, বেশি কাজ পাওয়া আমিনুল হক, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশী), দেলোয়ার হোসেন, মাহফুজ খান লিমিটেড, রানা বিল্ডার্স, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ (এনডিআই) ২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত চলছে।

ঠিকাদারেরা জালিয়াতি করতে পেরেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের বিচার হওয়া উচিত। পাশাপাশি সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিচার হতে হবে। নইলে জালিয়াতি বন্ধ হবে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

আগে ধরা পড়েনি

অতীতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্র জমা দিতে বাধা দিতেন। সেটি থামাতে ২০১১ সালে চালু হয় ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থা (ই-জিপি), যেখানে অনলাইনে দরপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, যাতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। এ ব্যবস্থার সহায়ক হিসেবে রয়েছে টেন্ডার ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (টিডিএমএস) এবং টেন্ডার অ্যান্ড কন্ট্রাক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (টিসিআইএস)। এই দুটি ব্যবস্থায় ২০১৭ সাল থেকে সওজে যত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যারা কাজ পেয়েছে, ঠিকাদারদের জমা দেওয়া নথিপত্র রয়েছে।

সর্বশেষ পাঁচ বছরে সংখ্যায় বেশি কাজ করা, টাকার পরিমাণে বেশি কাজ করা এবং চলমান কাজের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নম্বর ঠিক হয়। কাজের সংখ্যা বেশি দেখাতেই নথি জাল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় নথিপত্র টিডিএমএসে আপলোড (অনলাইনে জমা) করার দায়িত্ব ঠিকাদারের। আর দরপত্র আহ্বানকারী সওজের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হলো সেটা অনুমোদন করে সংরক্ষণ করা।

দরপত্র মূল্যায়নের সময় ভুয়া নথিপত্র ধরা পড়ার কথা; কিন্তু সেটা হয়নি। এই সুযোগে একের পর এক কাজ বাগিয়েছেন ঠিকাদারেরা। দায়ী ঠিকাদারদের নিষিদ্ধ করা শুরু হলেও ‘জালিয়াতির সহযোগী’ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

জানতে চাইলে সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনউল্লাহ নূরী প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ঠিকাদার; সবাই বিচারের আওতায় আসবেন। এ জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে ই-জিপি পদ্ধতি চালুর পর সওজ যেসব দরপত্র আহ্বান করেছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্মুক্ত পদ্ধতির (ওটিএম) দরপত্রই বেশি। এ ধরনের দরপত্র আহ্বান করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে। ঠিকাদার প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি বা কম দর প্রস্তাব করলে তা বাতিল করা হয়।

সওজ সূত্র বলছে, প্রাক্কলিত ব্যয় ঠিকাদারের জানার কথা নয়। তবে সওজে রীতি হয়ে গেছে যে সব ঠিকাদারকেই প্রাক্কলিত ব্যয় বলে দেওয়া হয়। আর সবাই ১০ শতাংশ কম ধরে দর প্রস্তাব করে। এতে অংশগ্রহণকারী সবার দর এক হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে কে কাজ পাবে, তা নির্ধারণ করতে সিপিটিউ ‘পাস্ট পারফরম্যান্স ইভালুয়েশন ম্যাট্রিক্স’ (অতীত পারদর্শিতা মূল্যায়ন ব্যবস্থা) চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে ৩০০ নম্বর রয়েছে। সর্বশেষ পাঁচ বছরে সংখ্যায় বেশি কাজ করা, টাকার পরিমাণে বেশি কাজ করা এবং চলমান কাজের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নম্বর ঠিক হয়। কাজের সংখ্যা বেশি দেখাতেই নথি জাল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
অবশ্য সওজের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার মত হলো, সারা দেশে সড়কের পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য। কিছু ঠিকাদার নিষিদ্ধ হলেও অসুবিধা নেই। কারণ, আরও অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বিচার ‘হতে হবে’

সারা দেশের মহাসড়ক ও জেলা সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সওজের। সংস্থাটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে তারা বরাদ্দ পেয়েছিল ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলমান কাজ, জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে গড়ে প্রতিবছর অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার কাজের দরপত্র ডাকে সংস্থাটি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঠিকাদারেরা জালিয়াতি করতে পেরেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের বিচার হওয়া উচিত। পাশাপাশি সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিচার হতে হবে। নইলে জালিয়াতি বন্ধ হবে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

সড়কে বেশি কাজ পাওয়া পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তিনটি নিষিদ্ধ

আপডেট সময় ০১:৫২:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ মার্চ ২০২৪

জালিয়াতিতে জড়িত ২৬টি প্রতিষ্ঠান সড়কের ৯০% কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।সড়কের যে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কাজ পায়, তাদের তিনটিই জালিয়াত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নতুন নতুন ঠিকাদারি কাজ পেতে তারা নথি জাল করেছে বলে উঠে এসেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তদন্তে। দুটির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত চলছে।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, তারা মোট ২৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পেয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ ছয়টিকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

২৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পেয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ৬টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম রেজাউল করিমকে প্রধান করে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গত জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়। ফেব্রুয়ারি থেকে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়।

সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, তাঁরা তদন্ত করে কিছু জালিয়াতি পেয়েছেন, ব্যবস্থাও নিয়েছেন। এটা চলমান প্রক্রিয়া। আরও যাচাই-বাছাই চলছে। যাদেরই জালিয়াতি পাওয়া যাবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, যে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পাওয়া গেছে, তারা সড়কের ৯০ শতাংশের বেশি ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সড়কে কাজ করা ঠিকাদারের মোট সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১০০।

জালিয়াতি চার ধরনের: ১. জাল কর্মসম্পাদন সনদ জমা দেওয়া। অর্থাৎ যে ঠিকাদারি কাজ তারা করেনি, সেগুলোও উল্লেখ করেছে। ২. টাকার অঙ্কে কাজের পরিমাণ বেশি দেখানো। ৩. কাজ শেষ করেছে দেরিতে, কিন্তু দেখিয়েছে তারা যথাসময়ে কাজ করেছে। ৪. আর্থিক সক্ষমতা দেখাতে একটি দরপত্রে একই সনদ বারবার জমা দেওয়া। ৫. যৌথ উদ্যোগের ভুয়া তথ্য জমা দেওয়া।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, যে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি পাওয়া গেছে, তারা সড়কের ৯০ শতাংশের বেশি ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সড়কে কাজ করা ঠিকাদারের মোট সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১০০।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), গণপূর্ত অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছে, যার মধ্যে জাল সনদ রয়েছে।

দরপত্রবিষয়ক তথ্যভান্ডার টেন্ডার ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (টিডিএমএস) তথ্য বলছে, বিগত পাঁচ বছরে সওজে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ১০০টি ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। কাজগুলো টাকার অঙ্কে ছোট। সম্মিলিত পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তারা ঢাকা অঞ্চলে বেশি কাজ পেয়েছে।

সড়কের আরেক শীর্ষস্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আগামী জুন পর্যন্ত। বিগত পাঁচ বছরে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ সড়কে প্রায় ১ হাজার ২২০টি ঠিকাদারি কাজ করেছে, যার অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে মেসার্স সালেহ আহমেদ ও জামান এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর এবং মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে আগামী জুন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ঠিকাদার; সবাই বিচারের আওতায় আসবেন। এ জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে।

সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনউল্লাহ নূরী

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সালেহ আহমেদের মালিক সালেহ আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান ভুল করেনি। কয়েকটি কাজে আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অংশ নিয়েছিলেন। আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনোর নথিপত্রে সমস্যা আছে। এর জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, বেশি কাজ পাওয়া আমিনুল হক, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশী), দেলোয়ার হোসেন, মাহফুজ খান লিমিটেড, রানা বিল্ডার্স, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ (এনডিআই) ২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত চলছে।

ঠিকাদারেরা জালিয়াতি করতে পেরেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের বিচার হওয়া উচিত। পাশাপাশি সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিচার হতে হবে। নইলে জালিয়াতি বন্ধ হবে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

আগে ধরা পড়েনি

অতীতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্র জমা দিতে বাধা দিতেন। সেটি থামাতে ২০১১ সালে চালু হয় ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থা (ই-জিপি), যেখানে অনলাইনে দরপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, যাতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। এ ব্যবস্থার সহায়ক হিসেবে রয়েছে টেন্ডার ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (টিডিএমএস) এবং টেন্ডার অ্যান্ড কন্ট্রাক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (টিসিআইএস)। এই দুটি ব্যবস্থায় ২০১৭ সাল থেকে সওজে যত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যারা কাজ পেয়েছে, ঠিকাদারদের জমা দেওয়া নথিপত্র রয়েছে।

সর্বশেষ পাঁচ বছরে সংখ্যায় বেশি কাজ করা, টাকার পরিমাণে বেশি কাজ করা এবং চলমান কাজের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নম্বর ঠিক হয়। কাজের সংখ্যা বেশি দেখাতেই নথি জাল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় নথিপত্র টিডিএমএসে আপলোড (অনলাইনে জমা) করার দায়িত্ব ঠিকাদারের। আর দরপত্র আহ্বানকারী সওজের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হলো সেটা অনুমোদন করে সংরক্ষণ করা।

দরপত্র মূল্যায়নের সময় ভুয়া নথিপত্র ধরা পড়ার কথা; কিন্তু সেটা হয়নি। এই সুযোগে একের পর এক কাজ বাগিয়েছেন ঠিকাদারেরা। দায়ী ঠিকাদারদের নিষিদ্ধ করা শুরু হলেও ‘জালিয়াতির সহযোগী’ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

জানতে চাইলে সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনউল্লাহ নূরী প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ঠিকাদার; সবাই বিচারের আওতায় আসবেন। এ জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে ই-জিপি পদ্ধতি চালুর পর সওজ যেসব দরপত্র আহ্বান করেছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্মুক্ত পদ্ধতির (ওটিএম) দরপত্রই বেশি। এ ধরনের দরপত্র আহ্বান করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে। ঠিকাদার প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি বা কম দর প্রস্তাব করলে তা বাতিল করা হয়।

সওজ সূত্র বলছে, প্রাক্কলিত ব্যয় ঠিকাদারের জানার কথা নয়। তবে সওজে রীতি হয়ে গেছে যে সব ঠিকাদারকেই প্রাক্কলিত ব্যয় বলে দেওয়া হয়। আর সবাই ১০ শতাংশ কম ধরে দর প্রস্তাব করে। এতে অংশগ্রহণকারী সবার দর এক হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে কে কাজ পাবে, তা নির্ধারণ করতে সিপিটিউ ‘পাস্ট পারফরম্যান্স ইভালুয়েশন ম্যাট্রিক্স’ (অতীত পারদর্শিতা মূল্যায়ন ব্যবস্থা) চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে ৩০০ নম্বর রয়েছে। সর্বশেষ পাঁচ বছরে সংখ্যায় বেশি কাজ করা, টাকার পরিমাণে বেশি কাজ করা এবং চলমান কাজের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নম্বর ঠিক হয়। কাজের সংখ্যা বেশি দেখাতেই নথি জাল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
অবশ্য সওজের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার মত হলো, সারা দেশে সড়কের পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য। কিছু ঠিকাদার নিষিদ্ধ হলেও অসুবিধা নেই। কারণ, আরও অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বিচার ‘হতে হবে’

সারা দেশের মহাসড়ক ও জেলা সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সওজের। সংস্থাটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে তারা বরাদ্দ পেয়েছিল ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলমান কাজ, জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে গড়ে প্রতিবছর অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার কাজের দরপত্র ডাকে সংস্থাটি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঠিকাদারেরা জালিয়াতি করতে পেরেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের বিচার হওয়া উচিত। পাশাপাশি সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিচার হতে হবে। নইলে জালিয়াতি বন্ধ হবে না।