কিশোর গ্যাং এক আতঙ্কের নাম , ১৫ বছরে রাজধানীতে ৮৬ খুন
- আপডেট সময় ০৫:৩০:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪
- / ২৩৩ বার পড়া হয়েছে
আট থেকে দশজনের একটি দল। সবাই কিশোর। শরীরে কালো পোশাক, মুখে মাস্ক, হাতে ধারালো চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র। সড়কের পাশে আড্ডারত চারজন ব্যক্তির ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় দলটি।
মাত্র ১০ মিনিটের ঘটনা। একই পদ্ধতিতে অন্তত ১০ দোকানি ও পথচারীকে ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি ও মারধর করে মোবাইল ফোনসহ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে দলের সবাই।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর শেখেরটেকের পিসিকালচার হাউজিংয়ে এমন অভিনব গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য মতে, এ ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত।
এভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে নিত্যনতুন কায়দায় অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। এর সঙ্গে উঠে আসছে কিশোর গ্যাংয়ের নাম।
মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারধর থেকে শুরু করে খুনের মতো বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর গ্যাংয়ের এমন অপরাধমূলক কাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। তাদের কাছে ক্রমে জিম্মি হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির হত্যার পর ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি নজরে আসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব কিশোর গ্যাং শুধু ছিনতাই, চাঁদাবাজি নয়, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়।
ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গত দুই বছরে ৩৪ জন কিশোর নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় গত বছর ২৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, নারীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ প্রভৃতি ঘটনা। এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় খুব নৃশংসভাবে। ছুরিকাঘাত করার পর ইট ও লাঠি দিয়ে মেরে পুরো শরীর, মুখ, মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মৃত্যুর পর লাশ গুমের উদ্দেশ্যে খণ্ডবিখণ্ড করার মতো নৃশংস ঘটনাও আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, একসময় মনে করতাম ভাসমান ও নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা কিশোর গ্যাং চক্রে জড়িত হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, উচ্চ মধ্যবিত্ত, ধনীদের আলালের ঘরের দুলালরাও কিশোর গ্যাং চক্রে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের পোশাক, চুলের কাটিং, চলাফেরা সবই ভীতিকর। প্রথমে মাদক সেবন, পরে মাদক বিক্রিতেও জড়িয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করছে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে স্থানীয় রাজনৈতিক ‘বড় ভাই’ এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রণে থেকে ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের নেপথ্যে বর্তমান ও সাবেক কাউন্সিলরদের ছত্রচ্ছায়ার তথ্যও মিলছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুই দিনের অভিযানে ৭৫ কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে কেউ সুপারিশ নিয়ে এলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবশ্য শুধু গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাং দমন করা যাবে না বলে জানান ডিবি প্রধান। তাঁর মতে, এই সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পরিবারের সদস্যদের কিশোর গ্যাং দমনে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের উচিত তাঁদের সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, তার খোঁজ রাখা। পাশাপাশি মা-বাবার উচিত সন্তানদের সময় দেওয়া।
পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আছে ১২৩টি কিশোর গ্যাং। বাকি ৫০টি অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে। একেকটি দলে সদস্যসংখ্যা ১০ থেকে ৫০।
বর্তমানে কিশোর গ্যাং গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের সব থানা ও জেলায় তালিকা করলে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে। বিশেষ করে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কিশোর গ্যাং অনেক বেড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মফস্বল শহরের মধ্যে যশোরে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। সেখানে ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং সক্রিয়। ওরা বিভিন্ন অপরাধের পাশাপাশি ভারতীয় মদ, ফেনসিডিল, গাঁজা, চিনি, পেঁয়াজ, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন প্রসাধনী ও ভোগ্য পণ্য চোরাচালান করে আসছে।
রাজধানীতে অন্তত ৮০ কিশোর গ্যাং
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, শুধু রাজধানীতেই রয়েছে ৮০টির বেশি কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে জুয়েল বাহিনী, কামরুল বাহিনী, অতুল বাহিনী, শাহিন শরীফ, গাংচিল বাহিনী, ভাস্কর বাহিনী, রুবেল বাহিনী, অনিক বাহিনী, পাটালি গ্রুপ, রাকিব গ্রুপ, মাউরা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, আর্মি আলমগীর ও নবী গ্রুপ, ডাইল্লা গ্রুপ, আনোয়ার গ্যাং, সাইফুলের গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাং, রিপন গ্যাং, মোবারক গ্যাং, নয়ন গ্যাং, তালাচাবি গ্যাং, নাইন এমএম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, স্টার বন্ড গ্রুপ, মোল্লা রাব্বির গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, ল ঠেলা গ্রুপ, আশরাফ গ্রুপ, কোপাইয়া দে, শাহীন-রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, শা গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, সোলেমান গ্যাং, রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং, বাংলা ও লাভলেট গ্যাং, জুম্মন গ্যাং, চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিউম টু, ভাণ্ডারি গ্যাং, টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গাল গ্যাং, লাগবি নাকি, মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, বিহারি রাসেল গ্যাং, বিচ্ছু বাহিনী, পিচ্চি বাবু, কবজি কাটা গ্রুপ, রাব্বি-বাতেন-রাকিব গ্রুপ অন্যতম। প্রতিটি গ্যাংয়ের সদস্যের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন করে।
অনুসন্ধান বলছে, এই গ্যাংগুলো উত্তরা, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান, টঙ্গী, সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, আগারগাঁও, মতিঝিল ও হাতিরঝিলে সক্রিয়।
সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা দুই শর বেশি। এসব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা রয়েছে প্রায় ৮০০টি। এসব মামলায় এক হাজারের বেশি আসামি রয়েছে।
জানা গেছে, গ্রেপ্তার কিশোরদের দেশের তিনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। বেশির ভাগ কিশোরই হত্যা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য, নারী ও শিশু নির্যাতন, পর্নোগ্রাফি, তথ্য-প্রযুক্তি মামলার আসামি।
নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা
সম্প্রতি পাঁচটি কিশোর গ্যাংয়ের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে কালের কণ্ঠ। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব কিশোর গ্যাংকে সরাসরি আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা কিংবা কথিত ‘বড় ভাই’। তাঁদের দেওয়া শেল্টারে দিনকে দিন মরিয়া হয়ে উঠেছে এসব গ্যাং। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয় কাউন্সিলরদের দিকেই উঠছে অভিযোগের আঙুল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুর থানায় একজন ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে চলে ২০ সদস্যের কিশোর গ্যাং। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মিরপুরেও সবচেয়ে বড় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের জাতীয় কমিটির এক সদস্য। তাঁর সহযোগী অতুল বাহিনীর প্রধান অতুলের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মাদকদ্রব্য কেনাবেচার অভিযোগ।
রাজধানীর আদাবর থানাধীন মনসুরাবাদ এলাকায় অন্যতম কিশোর গ্যাং রাব্বি-বাতেন-রাকিব গ্রুপ। এই গ্রুপের প্রধান রাব্বির বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ হত্যাচেষ্টার অভিযোগ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়ে থেকে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ওই নেতার বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নাকের ডগায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
আদাবর এলাকার আরেকটি কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছেন থানা ছাত্রলীগের এক নেতা। তাঁর বাহিনীতে রয়েছে ২০ জনের বেশি সক্রিয় সদস্য। এই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসা, ফুটপাত, নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ছাত্রলীগ নেতাকে আবার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন একজন কাউন্সিলর।
রাজধানীর অন্য প্রান্ত যাত্রাবাড়ীতেও একজন যুবলীগ নেতা গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং। স্থানীয়দের কাছে এই গ্যাং ত্রাস হিসেবে পরিচিত। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক ব্যবসার পাশাপাশি যাত্রাবাড়ীর ফুটপাতের ব্যবসায়ী, নির্মাণাধীন ভবন, বাজার এবং পরিবহন খাত থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে।
আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
এর আগেও গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলা গার্ডেন সিটি এলাকায় অস্ত্রের মুখে গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায় কিশোর গ্যাং। সে সময় ২০ জনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোনসহ টাকা-পয়সা ছিনতাই করা হয়।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে মোহাম্মদপুরের বসিলায় একই কায়দায় কমপক্ষে তিনবার গণছিনতাই করেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীরা আতঙ্কে মুখ খোলার সাহস পায় না।
জানা গেছে, গত ৭ মার্চ রাত ১০টার দিকে উত্তর মুগদায় লিটন এঞ্জেল গলিতে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন কবি নজরুল কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী পিয়াস ইকবাল নূর (২৩)। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে নূরকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। একই ঘটনায় ছুরিকাঘাতে আহত হন শামীম (২৪) নামের আরেক ভুক্তভোগী। এ ঘটনার তিন দিন পর রাজধানী ও পাশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
সম্প্রতি মিরপুর সাড়ে ১১ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগী মশিউর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, “রাত ৯টার দিকে বাসায় ঢোকার সময় প্রধান ফটকের সামনে অতর্কিতে কিশোর গ্যাংয়ের চার সদস্য পথ আটকে দাঁড়ায়। এ সময় তারা ছুরি ও ধারালো চায়নিজ কুড়াল দেখিয়ে আমাকে রীতিমতো জিম্মি করে ফেলে। এরপর মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে যায়। চলে যাওয়ার সময় তারা হুমকি দেয়, ‘আমরা আপনার বাসা চিনি। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে এর ফল ভালো হবে না।’”
মশিউরের মতো একই পরিস্থিতির শিকার রাজু খান নামের এক হকার বলেন, ‘শ্যামলী মাঠসংলগ্ন রাস্তায় আমি চশমা বিক্রি করি। একদিন সন্ধ্যায় রাস্তার ওপর থাকা হকার ও ক্রেতাদের কাছ থেকে গণছিনতাই শুরু করে কিশোর গ্যাং। ওদের কবল থেকে বাঁচতে দোকান ফেলে রেখেই পালিয়ে যাই। এর পরও কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা আমার দোকানে থাকা শতাধিক চশমা নিয়ে চলে যায়।’
ঢাকার পাশের নরসিংদীতে গত বছরের ৯ জুলাই হাত-পায়ের রগ কেটে ও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাতারকান্দি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিদকে হত্যা করে কিশোর গ্যাং। সামান্য ঝগড়ার রেশ ধরে তাকে হত্যা করা হয়।
নাহিদের চাচা বেজন মিয়া বলেন, ওই দিন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য বাড়ি থেকে কলেজে যাচ্ছিল নাহিদ। এ সময় এলাকার কিশোর গ্যাং সদস্য দেলোয়ার, সাইফুল, শান্ত, তুহিন, শাওন, নাজমুলসহ আরো কয়েকজন তাকে ধাওয়া করে ধরে হাত ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। ওই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তারা জামিনে বেরিয়ে বাদীপক্ষকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে মার্চ মাসের চলতি সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং সদস্য সন্দেহে ১০৭ জনকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এর মধ্যে ৩২ জনকে আটক করে র্যাব। অন্যদিকে গুলশান, উত্তরা, মতিঝিল আর তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ৭৫ জন সদস্যকে আটক করে ডিএমপি। অভিযানে ইয়াং স্টার, বিগ বস, ডিসকো বয়েজ, বন্ধুমহল, শীল বিষু গ্যাং, পারভেজ গ্রুপ, রুস্তম গ্রুপ, নাইন এমএম গ্রুপ, নাইন স্টার গ্রুপ, উজ্জ্বল গ্রুপর সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কিশোর গ্যাং কালচার নির্মূলে মদদদাতাদেরও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। যেকোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যাদের নামে মামলা হচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।