মহাখালী বাস টার্মিনালে কোটি টাকা বকেয়া রেখেও ইজারা পেলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি
- আপডেট সময় ০২:১৩:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
- / ২৭৮ বার পড়া হয়েছে
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারার টাকা চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে সিটি করপোরেশনকে পরিশোধ করেননি স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চু। পরে তাঁকে বকেয়া টাকা কিস্তিতে পরিশোধে সময় দেয় করপোরেশন। ওই সময়ের মধ্যেও তিনি টাকা দেননি।
চুক্তি ভাঙলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। উল্টো তাঁর কাছেই নতুন করে বাস টার্মিনালটির ইজারা দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (ভ্যাট-আয়করসহ ৪ কোটি ৬২ লাখ) মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারা গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজকে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটি গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চুর। এক বছর মেয়াদি ওই ইজারা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর আবেদন করেন ইজারাদার। আবেদন অনুযায়ী ঠিকাদারকে ওই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।
২০২২ সালের এপ্রিলে আগের ইজারামূল্যের বিনিময়েই সাচ্চুর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও এক বছরের জন্য ইজারা চুক্তি নবায়ন করে সিটি করপোরেশন। তবে এ দফায় তিনি ঠিকমতো ইজারার টাকা পরিশোধ করেননি। ইজারার নির্ধারিত মেয়াদ ২০২৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে তিনি ২ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। সেই হিসাবে বকেয়া ছিল ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
বকেয়া এই টাকা পরিশোধে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে বাড়তি সময় দেয় সিটি করপোরেশন। বলা হয় আট কিস্তিতে ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে। কিন্তু ইজারাদার দুই কিস্তিতে মাত্র ৪৩ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর করপোরেশনকে আর টাকা দেননি। ফলে তাঁর কাছে করপোরেশন আরও ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা পাবে।
এভাবে চুক্তি লঙ্ঘন করার পরও সাচ্চুর প্রতিষ্ঠানের কাছেই আরও এক বছরের জন্য (২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত) বাস টার্মিনালটির ইজারা দেওয়া হয়েছে। নতুন ইজারার কার্যাদেশ দেওয়া হয় গত ১২ মার্চ। এ কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই কৌশলে সাচ্চুকে আরও পাঁচ মাস অর্থাৎ মে পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধের সময় দেয় সিটি কর্তৃপক্ষ।
আগের দুবারের চেয়ে দেড় কোটি টাকা কমে এবার ইজারা
উত্তর সিটির পরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সরকারিভাবে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ইজারামূল্য নির্ধারণ করে গত আগস্টে মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। গাজী রাইয়ানসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান টার্মিনালের জন্য দরপত্র দিয়েছিল। কিন্তু কোনোটিই সরকারি দরের চেয়ে বেশি দেয়নি।
কাঙ্ক্ষিত দর না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় গত ২২ অক্টোবর আবার দরপত্র আহ্বান করে সিটি করপোরেশন। সেবার শুধু সাচ্চুর প্রতিষ্ঠান গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ও ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দর দেয়; যা সরকারি দরের চেয়ে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা বেশি। পরে প্রতিষ্ঠানটিকেই চূড়ান্ত করে গত ১২ মার্চ কার্যাদেশ দেয় সিটি করপোরেশন।
অথচ ২০২১ ও ২০২২ সালে দুই দফার প্রতিবারই টার্মিনালটির ইজারামূল্য ছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে যে টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেটি আগের মূল্যের চেয়ে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা কম।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে নতুন করে ইজারা দেওয়ার আগপর্যন্ত মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সিটি করপোরেশন খাস আদায় করে। খাস আদায়ের ৯ মাসের মধ্যে (২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে গত ২৮ জানুয়ারি) টার্মিনাল থেকে সিটি করপোরেশনের আয় হয় ২ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা; যা নতুন ইজারামূল্যের চেয়ে কিছু বেশি।
চুক্তি ভঙ্গ হলেও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ
২০২১ সালের জানুয়ারিতে গাজী মেজবাউল হোসেনের সঙ্গে সিটি কর্তৃপক্ষের বাস টার্মিনাল ইজারাসংক্রান্ত চুক্তি হয়। চুক্তির ৪ নম্বর শর্ত অনুযায়ী, ইজারামূল্যের টাকা চারটি কিস্তিতে (সমান ভাগে) পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তির টাকা চুক্তির আগে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তি কার্যাদেশ দেওয়ার (চুক্তির মেয়াদ শুরুর) ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। তৃতীয়টি ১৮০ দিনে ও চতুর্থটি ২৭০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
চুক্তিরই ২১ নম্বর শর্তে উল্লেখ ছিল, ইজারাদার চুক্তির যেকোনো শর্ত ভাঙলে সিটি করপোরেশন ইজারা বাতিল করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু অজানা কারণে চুক্তির শর্তভঙ্গের পরও ইজারাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ইজারাদার ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাতেই ওই নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিষয়টি বিবেচনা করেই সর্বশেষ দরপত্রের শর্তেও অতীতে খেলাপি ইজারাদারের বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না।’
এসব বিষয়ে গাজী মেজবাউল হোসেন বলেন, ‘এটা মাননীয় মেয়র মহোদয় আমার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন, এই টুকুই। আর কিছু না। আমি কখনোই দলীয় প্রভাব দেখিয়ে কোনো কিছু করতে চাই না। কখনো দলের নাম বিক্রি করে কোথাও কিছু করেছি, এ রকম কোনো প্রমাণ পাবেন না।’ ইজারা নিয়ে অনেক টাকা লোকসান হওয়ার কারণেই বকেয়া রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আগের বকেয়া পরিশোধে ইজারাদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী মে মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে বকেয়া আদায়ে পরিবহন বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইজারাদার বকেয়া পরিশোধ না করলে, তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেয়র আরও বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাস টার্মিনালের ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এবার কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই ইজারার পুরো টাকা নিয়ে নেওয়া হয়েছে।