মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার কান্ডের সাথে জরিত উপজেলা আওয়ামীলীগ সদস্য : তদন্ত কমিটি
- আপডেট সময় ০৬:০৯:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪
- / ৩১২ বার পড়া হয়েছে
ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে শ্রমিকেরা আগুন দেননি বলে নিশ্চিত হয়েছে কমিটি।
এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদউজ্জামান, সদস্য অজিত বিশ্বাস ও অমৃত কুমার বসু নামের এক গ্রাম পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ত থাকার সত্যতা পেয়েছে কমিটি। শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ মারধর শুরু করলে শ্রমিকদের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েন গ্রামবাসী। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রটে (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য ‘সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া’র ভূমিকায় ছিলেন। তাঁদের নিখুঁত অভিনয় প্রথমে ধরা যায়নি। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। তাদের উচিত ছিল, শ্রমিকদের থানায় নিয়ে যাওয়া।
গত ১৮ এপ্রিল রাতে মধুখালীর পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে মন্দিরে প্রতিমার গায়ের কাপড়ে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দুই নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রটানো হয় যে মন্দিরে আগুন দেওয়ায় গণপিটুনিতে দুই সহোদর নিহত হয়েছেন। ঘটনার পর এডিএম মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দিরে প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগার ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। আগুন নেভাতে গ্রামবাসীর সঙ্গে মন্দিরসংলগ্ন পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরাও বালতি হাতে অংশ নেন। এলাকাটি সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত হওয়ায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রামবাসী নির্মাণশ্রমিকদের সন্দেহ করেন। ওই সন্দেহ থেকে গ্রামবাসী শ্রমিকদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে বেঁধে রাখেন। খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রতিনিধিরা আগুন লাগানোর জন্য শ্রমিকদের দায়ী করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। তখন দুজন জনপ্রতিনিধি ও এক গ্রাম পুলিশ সদস্য শ্রমিকদের কিল–ঘুষি, চড়-থাপ্পড় মারেন। তাঁদের এই আচরণ উসকানি হিসেবে কাজ করে। এতে গ্রামবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ওই কক্ষে শ্রমিকেরা ছাড়া ইউপি চেয়ারম্যান, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় তিন শিক্ষকসহ ৮-১০ জনের বেশি লোক ছিলেন না। গ্রামবাসী কক্ষের বাইরে থেকে ইট ছুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান পুলিশকে খবর দেন।
ঘটনার পর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সবার পাশে থেকে আহত শ্রমিকদের উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেন ইউপি চেয়ারম্যান। পরে তদন্তকাজেও সাহায্য করেন। এ ঘটনার তিনটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে যায়। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য আত্মগোপন করলেও গ্রাম পুলিশ সদস্যকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা এড়াতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে, প্রতিটি মন্দির ও বিদ্যালয় সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা; মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদার করতে উঁচু প্রাচীর তৈরি করা; এমন ঘটনা মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; কোনো এলাকায় একই ধর্মের লোক বেশি বাস করলে সেখানে অন্য ধর্মের কেউ কাজ করতে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে রাখা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচার-প্রচারণা চালানো।
মধুখালীর ঘটনায় হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিরাজ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত পুলিশের ওপর হামলার মামলায় ৩১ জন ও হত্যা মামলায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের ওপর হামলার মামলায় চারজন ও হত্যা মামলায় সাতজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।