ঢাকা ০২:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪, ৯ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডিএমপির সাবেক কমিশনার মিয়া সাহেবের অবৈধ সম্পদের পাহাড়

নিউজ ডেস্ক:-
  • আপডেট সময় ১০:২৭:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ জুন ২০২৪
  • / ১৯৩৩ বার পড়া হয়েছে

বাড়ির পর বাড়ি। জমি এবং ফ্ল্যাটের সারি। কী নেই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়ার। রীতিমতো গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তবে শুধু নিজের নামে নয়। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামেও বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন ডিএমপি’র সাবেক এই কমিশনার। অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের সম্পদের পাহাড়ের। অনেক সম্পদের নথিও এসেছে গণমাধ্যমের হাতে হাতে। সরজমিন যার সত্যতা মিলেছে।

পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোড। এখানে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামানের নামে।

পাশের একটি প্লটের কেয়ারটেকার হালিম বলেন, এটা এক পুলিশ কর্মকর্তার জমি বলে আমরা জানি। এখানে তিনি মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে দেখে যান। তবে তাদের নামে কোনো সাইনবোর্ড দেয়া হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা এবং জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত মো. শামীম বলেন, পূর্বাচলের এই প্লটের প্রতি কাঠা জমির মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। পূর্বাচলের সেক্টর ৪, রোড ১০৮-এ ৫৩ নম্বর প্লটটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ছিল।  ৫ কাঠার এই প্লটটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। জমিকেনা বেচায় যুক্ত স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, প্লটটি শুনেছি তারা বিক্রি করে দিয়েছেন। আগে এখানে তারা আসলেও এখন আসেন না।

আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের, এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোড দিয়ে প্রবেশ করলে স্থানীয় মসজিদের সামনে বাউন্ডারি দেয়া ৩৬ নম্বর প্লটে ২১ কাঠা জমি রয়েছে। এই প্লটটিও আছাদুজ্জামান মিয়ার। এই প্লটটি ৮ নম্বর রোডের সবচেয়ে বড় প্লট। এখানে প্রতিটি প্লট সর্বোচ্চ ৫ কাঠা ও তার সামান্য কিছু বেশি। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন জানান, আছাদুজ্জামান মিয়া পরিবারসহ মাঝে মধ্যে এসে প্লট দেখে যান। বাউন্ডারি দিলেও কোনো সাইনবোর্ড দেননি।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১ এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠার উপর ৬ তলাবিশিষ্ট আলিশান বাড়িটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে। স্কুলের কেয়ারটেকার জানান, বাড়িটি বর্তমানে ভাড়া দেয়া। যা স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটির বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। নিকুঞ্জ-১ এর ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীনের নামে। ভবনের পাশের একজন বাসিন্দা নাম-পরিচয় গোপন রেখে বলেন, সম্প্রতি তারা বাসার নেমপ্লেট খুলে রেখেছেন। কেন রেখেছেন জানি না। বাড়িটির মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি।

সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩ নম্বর ভবনে ৩ হাজার ৮শ’ থেকে ৪ হাজার স্কয়ার বর্গফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে আছাদুজ্জামানের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে। বাড়ির এক নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, আয়েশা সিদ্দিকা বর্তমানে এই বাসায় নেই। ফ্ল্যাটটি তার নামে রয়েছে। ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, ফ্ল্যাটটি বর্তমানে ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ থাকেন না। এ সময় তিনি ভবনের সকল ফ্ল্যাট মালিকদের নামের লিস্ট বের করে দেখান। এদিকে ধানমণ্ডির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়ির বি/২/৫ ভবনে যোগাযোগ করে জানা যায় ভবনটিতে এককাঠা জমিসহ আছাদুজ্জামান মিয়ার পরিবারের সদস্যদের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ বিষয়ে ভবনের দায়িত্বে থাকা সাইদ বলেন, ৬ তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে ২০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এখানে ফ্ল্যাটের মূল্য ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। এই ভবনটি আছাদুজ্জামান মিয়া স্যারের বলে আমরা জানি। ভবনটি খালি পড়ে আছে। বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে।

অন্তত দু’টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানার। আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকা, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমির সন্ধান মিলেছে। ২০১৮ সালে তিনি রাজউক থেকে একটি প্লট বিশেষ কোটায় বরাদ্দ পান। অথচ রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকার গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ৪১ শতাংশ জমি রয়েছে। যা কেনা হয়েছে ২০১৭ সালে। একই মৌজায় একই বছরের ১৬ই নভেম্বর তার নামে কেনা হয় আরও ২৬ শতাংশ জমি। একই মৌজায় তার নামে ২০১৯ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি কেনা হয় আরও ৩৯ শতাংশ জমি।

আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় ৫ কাঠা জমি কেনা হয়। একই বছরে একই মৌজায় কেনা হয় ১০ কাঠা জমি। একই বছরে গাজীপুরের চাঁদখোলা মৌজায় ৩১ শতক জমি ক্রয় করেন আফরোজা। এ ছাড়া আফরোজা ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল- কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর জমি কেনেন। একই বছরে একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনেন তিনি। ওই বছরই রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৬০ একর জমি তার নামে কেনা হয়। পরে তা বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ছাড়াও ২০১৯ সালে কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৫৭ একর জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পান আছাদুজ্জামানের স্ত্রী। একই বছরে আবার সেই জমি বিক্রিও করেন। দুটি কোম্পানির অংশীদার হয়েছেন আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা। এর মধ্যে একটি মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। এ কোম্পানিতে তার চার হাজার শেয়ার রয়েছে। আসাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালীন রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। সে সময় মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেয়া হয়।

এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান। তিনি আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের সৎ ভাই। এক সময় তিনি লেবার ভিসায় সৌদি যান। পরে দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে রাজধানীর নিউমার্কেটে তাদের নিজস্ব জুয়েলারি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত।

আছাদুজ্জামানের এক শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলন। তার নামে গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি রয়েছে। ভাগ্নে কলমের নামেও গাজীপুরে জমি আছে দেড় একর। অথচ আজীবন গ্রামে থাকা মিলনের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। অন্যদিকে ভাগ্নে কলমও গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকা দামের জমির মালিক। এই কলম আবার আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের ৮৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর তার নিয়োগের ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। আছাদুজ্জামান মিয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩তম কমিশনার ছিলেন।

সম্পদের বিষয়ে জানতে একাধিকবার আছাদুজ্জামান মিয়াকে ফোন দিলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন রিসিভ করে তিনি তা কেটে দেন। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া তার স্ত্রী আফরোজা ও বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতকে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে আছাদুজ্জামানের শ্যালক নুর আলম বলেন, তার নামে জমি আছে এ তথ্য সঠিক নয়।

মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান বলেন, আমি এক সময় প্রবাসে থাকলেও বর্তমানে একাধিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আমার নিজস্ব গোল্ড ও জুয়েলারির ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া একাধিক কোম্পানি রয়েছে। তিনি কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন এবং এ সকল সম্পদ তার বোন জামাই আছাদুজ্জামানের কিনা জানতে চাইলে হারিসুর বলেন, আমার ব্যবসায় প্রায় আরও ৮ থেকে ১০ জন পার্টনার রয়েছে। এটা পুরোটাই আমার নিজস্ব মালিকানাধীন। এর সঙ্গে আমার বোন জামাইয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশীর্বাদ ছাড়া এ ধরনের দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। একদিকে প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ অবস্থান অপরদিকে রাজনৈতিক আশীর্বাদ একত্রিত হয়ে তাদের দুর্নীতি এবং অসামঞ্জস্য আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা আইনের সুরক্ষার পরিবর্তে ভক্ষক হয়ে গেছেন। তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রক। তার মানে তারা জানেন কোন অপরাধ কীভাবে করতে হয়। এটা জেনে বুঝেই করেছেন। তারা যে অসামঞ্জস্য অপরাধগুলো করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু এক ধরনের সহযোগী আছে। তাদের অনেকেই হয়তো জেনে বা না জেনে অংশীদার হয়েছেন। এ অবস্থায় সব অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া অন্য কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই।

নিউজটি শেয়ার করুন

ডিএমপির সাবেক কমিশনার মিয়া সাহেবের অবৈধ সম্পদের পাহাড়

আপডেট সময় ১০:২৭:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ জুন ২০২৪

বাড়ির পর বাড়ি। জমি এবং ফ্ল্যাটের সারি। কী নেই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়ার। রীতিমতো গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তবে শুধু নিজের নামে নয়। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামেও বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন ডিএমপি’র সাবেক এই কমিশনার। অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের সম্পদের পাহাড়ের। অনেক সম্পদের নথিও এসেছে গণমাধ্যমের হাতে হাতে। সরজমিন যার সত্যতা মিলেছে।

পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোড। এখানে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামানের নামে।

পাশের একটি প্লটের কেয়ারটেকার হালিম বলেন, এটা এক পুলিশ কর্মকর্তার জমি বলে আমরা জানি। এখানে তিনি মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে দেখে যান। তবে তাদের নামে কোনো সাইনবোর্ড দেয়া হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা এবং জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত মো. শামীম বলেন, পূর্বাচলের এই প্লটের প্রতি কাঠা জমির মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। পূর্বাচলের সেক্টর ৪, রোড ১০৮-এ ৫৩ নম্বর প্লটটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ছিল।  ৫ কাঠার এই প্লটটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। জমিকেনা বেচায় যুক্ত স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, প্লটটি শুনেছি তারা বিক্রি করে দিয়েছেন। আগে এখানে তারা আসলেও এখন আসেন না।

আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের, এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোড দিয়ে প্রবেশ করলে স্থানীয় মসজিদের সামনে বাউন্ডারি দেয়া ৩৬ নম্বর প্লটে ২১ কাঠা জমি রয়েছে। এই প্লটটিও আছাদুজ্জামান মিয়ার। এই প্লটটি ৮ নম্বর রোডের সবচেয়ে বড় প্লট। এখানে প্রতিটি প্লট সর্বোচ্চ ৫ কাঠা ও তার সামান্য কিছু বেশি। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন জানান, আছাদুজ্জামান মিয়া পরিবারসহ মাঝে মধ্যে এসে প্লট দেখে যান। বাউন্ডারি দিলেও কোনো সাইনবোর্ড দেননি।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১ এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠার উপর ৬ তলাবিশিষ্ট আলিশান বাড়িটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে। স্কুলের কেয়ারটেকার জানান, বাড়িটি বর্তমানে ভাড়া দেয়া। যা স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটির বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। নিকুঞ্জ-১ এর ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীনের নামে। ভবনের পাশের একজন বাসিন্দা নাম-পরিচয় গোপন রেখে বলেন, সম্প্রতি তারা বাসার নেমপ্লেট খুলে রেখেছেন। কেন রেখেছেন জানি না। বাড়িটির মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি।

সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩ নম্বর ভবনে ৩ হাজার ৮শ’ থেকে ৪ হাজার স্কয়ার বর্গফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে আছাদুজ্জামানের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে। বাড়ির এক নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, আয়েশা সিদ্দিকা বর্তমানে এই বাসায় নেই। ফ্ল্যাটটি তার নামে রয়েছে। ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, ফ্ল্যাটটি বর্তমানে ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ থাকেন না। এ সময় তিনি ভবনের সকল ফ্ল্যাট মালিকদের নামের লিস্ট বের করে দেখান। এদিকে ধানমণ্ডির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়ির বি/২/৫ ভবনে যোগাযোগ করে জানা যায় ভবনটিতে এককাঠা জমিসহ আছাদুজ্জামান মিয়ার পরিবারের সদস্যদের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ বিষয়ে ভবনের দায়িত্বে থাকা সাইদ বলেন, ৬ তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে ২০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এখানে ফ্ল্যাটের মূল্য ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। এই ভবনটি আছাদুজ্জামান মিয়া স্যারের বলে আমরা জানি। ভবনটি খালি পড়ে আছে। বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে।

অন্তত দু’টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানার। আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকা, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমির সন্ধান মিলেছে। ২০১৮ সালে তিনি রাজউক থেকে একটি প্লট বিশেষ কোটায় বরাদ্দ পান। অথচ রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকার গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ৪১ শতাংশ জমি রয়েছে। যা কেনা হয়েছে ২০১৭ সালে। একই মৌজায় একই বছরের ১৬ই নভেম্বর তার নামে কেনা হয় আরও ২৬ শতাংশ জমি। একই মৌজায় তার নামে ২০১৯ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি কেনা হয় আরও ৩৯ শতাংশ জমি।

আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় ৫ কাঠা জমি কেনা হয়। একই বছরে একই মৌজায় কেনা হয় ১০ কাঠা জমি। একই বছরে গাজীপুরের চাঁদখোলা মৌজায় ৩১ শতক জমি ক্রয় করেন আফরোজা। এ ছাড়া আফরোজা ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল- কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর জমি কেনেন। একই বছরে একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনেন তিনি। ওই বছরই রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৬০ একর জমি তার নামে কেনা হয়। পরে তা বিক্রি করে দেয়া হয়। এ ছাড়াও ২০১৯ সালে কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ৫৭ একর জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পান আছাদুজ্জামানের স্ত্রী। একই বছরে আবার সেই জমি বিক্রিও করেন। দুটি কোম্পানির অংশীদার হয়েছেন আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা। এর মধ্যে একটি মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। এ কোম্পানিতে তার চার হাজার শেয়ার রয়েছে। আসাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালীন রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। সে সময় মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেয়া হয়।

এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান। তিনি আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের সৎ ভাই। এক সময় তিনি লেবার ভিসায় সৌদি যান। পরে দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে রাজধানীর নিউমার্কেটে তাদের নিজস্ব জুয়েলারি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত।

আছাদুজ্জামানের এক শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলন। তার নামে গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি রয়েছে। ভাগ্নে কলমের নামেও গাজীপুরে জমি আছে দেড় একর। অথচ আজীবন গ্রামে থাকা মিলনের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। অন্যদিকে ভাগ্নে কলমও গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকা দামের জমির মালিক। এই কলম আবার আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের ৮৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর তার নিয়োগের ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। আছাদুজ্জামান মিয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩তম কমিশনার ছিলেন।

সম্পদের বিষয়ে জানতে একাধিকবার আছাদুজ্জামান মিয়াকে ফোন দিলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন রিসিভ করে তিনি তা কেটে দেন। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া তার স্ত্রী আফরোজা ও বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতকে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে আছাদুজ্জামানের শ্যালক নুর আলম বলেন, তার নামে জমি আছে এ তথ্য সঠিক নয়।

মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান বলেন, আমি এক সময় প্রবাসে থাকলেও বর্তমানে একাধিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আমার নিজস্ব গোল্ড ও জুয়েলারির ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া একাধিক কোম্পানি রয়েছে। তিনি কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন এবং এ সকল সম্পদ তার বোন জামাই আছাদুজ্জামানের কিনা জানতে চাইলে হারিসুর বলেন, আমার ব্যবসায় প্রায় আরও ৮ থেকে ১০ জন পার্টনার রয়েছে। এটা পুরোটাই আমার নিজস্ব মালিকানাধীন। এর সঙ্গে আমার বোন জামাইয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশীর্বাদ ছাড়া এ ধরনের দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। একদিকে প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ অবস্থান অপরদিকে রাজনৈতিক আশীর্বাদ একত্রিত হয়ে তাদের দুর্নীতি এবং অসামঞ্জস্য আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা আইনের সুরক্ষার পরিবর্তে ভক্ষক হয়ে গেছেন। তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রক। তার মানে তারা জানেন কোন অপরাধ কীভাবে করতে হয়। এটা জেনে বুঝেই করেছেন। তারা যে অসামঞ্জস্য অপরাধগুলো করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু এক ধরনের সহযোগী আছে। তাদের অনেকেই হয়তো জেনে বা না জেনে অংশীদার হয়েছেন। এ অবস্থায় সব অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া অন্য কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই।