জেলায় জেলায় হামলা–সংঘর্ষ, অবরোধ
- আপডেট সময় ০৩:৪৬:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই ২০২৪
- / ১৪২ বার পড়া হয়েছে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা থামেনি। গতকাল বুধবার সরকারি ছুটির দিনেও রাজধানীসহ দেশের অন্তত আট জেলায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অন্তত ১০টি জায়গায় সড়ক ও মহাসড়ক এবং দুই জায়গায় রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এসব ঘটনায় ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দিনভর সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
আন্দোলনের প্রথম কয়েক দিন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও গত সোম ও মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ছয়জন নিহত হন। এরপর দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সিটি করপোরেশন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।
নিহত ব্যক্তিদের প্রতীকী কফিন নিয়ে মিছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে গতকাল ছুটির দিনেও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সড়ক-মহাসড়ক-রেলপথ অবরোধ করেন। আন্দোলনকারীদের এসব কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা এবং সরকার-সমর্থক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হামলা এবং পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
হামলা-সংঘর্ষ
মাদারীপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ডে এ ঘটনা ঘটে।
ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছেন। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ এ কে এম হাসিবুল হাসানসহ পাঁচজন আহত হন। আহতদের মধ্যে দুজন ছাত্রী ও দুজন ছাত্র রয়েছেন।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে গতকাল কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কে তিন ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। প্রথমে হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারে সড়কে অবস্থানরত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ মাইকিং করে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। পরে তাঁদের ধাওয়া করলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে দুই পক্ষের অন্তত পাঁচজন আহত হন।
জামালপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টাকালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এতে পাঁচ আন্দোলনকারী আহত হন। দুপুর ১২টার দিকে জাজিরার নাওডোবা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শহরের জেলা ও দায়রা জজের বাসভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজ এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে দুই শিক্ষার্থী আহত হন।
শেরপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশের ১০ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।
মহাসড়ক অবরোধ
রাজধানীর শনির আখড়ায় গতকাল দিনভর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এখানে পুলিশের ছররা গুলিতে ছয়জন আহত হন।
বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এতে অংশ নেন। বেলা দেড়টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিতে নগরের চৌমাথা এলাকায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসংলগ্ন এলাকায়। সেখানে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অবরোধ চলছিল।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশের প্রতিবাদে বিকেল চারটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে দক্ষিণের সব জেলার সঙ্গে বরিশালের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুরের ইচলাদী এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এ ছাড়া কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এবং ঘাটাইল কলেজ মোড় এলাকায় শিক্ষার্থীরা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
মুন্সিগঞ্জ শহর ও লৌহজংয়ে পদ্মা সেতু উত্তর থানার সামনে সকাল ১০টা থেকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এখানে বাধা দেয় ছাত্রলীগ এবং হামলা চালায় পুলিশ। এ সময় পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতুতে যান চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় ৪০ মিনিট। এখানে আহত হন ১০-১২ জন।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ থানার ভেতরে অবস্থান নেয়। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা থানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। একপর্যায়ে পুলিশ থানা থেকে বের হয়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টা থেকে তাঁরা প্লাস্টিক ড্রাম, ফলের কার্টন, রিকশা ভ্যান দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখেন।
খুলনা শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকা অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জিরো পয়েন্ট এলাকার চারটি সড়ক বন্ধ করে এ কর্মসূচি শুরু করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকেল চারটা পর্যন্ত তাঁরা এলাকাটি অবরোধ করে রাখেন। পরে কর্মসূচিতে যোগ দেন খুলনার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। জিরো পয়েন্ট অবরোধের ফলে সাতক্ষীরা, যশোর, ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বগুড়ার শেরপুরে বেলা ১১টা থেকে ৮০০ থেকে ৯০০ শিক্ষার্থী জড়ো হন। মহাসড়কের অন্তত তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল ছড়িয়ে পড়ে এ সময়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এ সময় পুলিশের শেরপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম আহত হন।
রেলপথ অবরোধ
যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় রাজশাহীগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেন থামিয়ে রেলপথ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা জাতীয় পতাকা দেখিয়ে ও ইট-পাথর ছুড়ে ট্রেনটি থামিয়ে দেন। ট্রেনের চালক ট্রেন থামিয়ে পালিয়ে যান। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীরা ট্রেনের ছাদে উঠে জাতীয় পতাকা ওড়ান। এ সময় যশোরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
গাইবান্ধা শহরে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে পৌর পার্কে সমবেত হন। তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে রেলগেটের সামনে অবস্থান নিয়ে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]