ঢাকা ১২:২৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এস আলমের হয়ে ব্যাংকের টাকা লুটের ছক আঁকেন আকিজ

নিউজ ডেস্ক:-
  • আপডেট সময় ০৩:৩৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪
  • / ১২৩ বার পড়া হয়েছে

ডিগ্রি পাস করার পর ২০০৯ সালে আকিজ উদ্দিন এস আলম গ্রুপের মালিকাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরই মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের প্রটোকল অফিসার (পিএস) হন। তিনি এস আলমের এস আলমের এতটাই মন জয় করেন যে, ১৪ বছরের ব্যবধানে অস্বাভাবিক পদোন্নতি পেয়ে বনে যান ইসলামী ব্যাংকের মতো দেশসেরা প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। অথচ একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে ডিএমডি পদে আসতে হলে তার অন্তত ২৪-২৬ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তার হাতে। তিনি আর কেউ নন, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন।

জনমুখে এতটাই প্রচারিত যে, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান আকিজ উদ্দিন ব্যাংকের টাকা লুট করে অল্প সময়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, অনেক ধন-সম্পদ, ফ্যাট-প্লট, দেশে-বিদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের দাবি, সফল ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক, সৎ ও দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১২ সালে আকিজ উদ্দিন তার প্রকোটল অফিসারের দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকের টাকা লুটের নানা ছক আকেন। ইসলামী ব্যাংকের ১১ জন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকলেও ব্যাংকের সার্বিক পরিচালনা বা কর্তৃত্বে ছিলেন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দীন ও মোহাম্মদ সাব্বির। এই তিনজনই ব্যাংকের সবকিছু। অন্যরা রুটিন কাজ বা হুকুম পালন করেন মাত্র।

অভিযোগ উঠেছে, গত ৬ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৮৯ কোটি টাকার ‘বেনামি ঋণের’ মাধ্যমে অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ডিএমডি আকিজ উদ্দিন। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের তৎপরতায় ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলন আটকে যায়। এসব অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করছিল আকিজ উদ্দিনের মালিকাধীন ‘গোল্ডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামে দু’টি প্রতিষ্ঠান।

ইসলামী ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় সোনালী, জনতা, রূপালী, পূবালী ও সিটি ব্যাংকে ‘গোল্ডেন স্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি চেক নগদায়নের জন্য পাঠানো হয়। ওই পাঁচটি চেক চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে ৩৪৬ কোটি টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের তৎপরতায় তা আটকে যায়। একই দিন টপ টেন ট্রেডিংয়ের ৫৪৮ কোটি টাকার বেনামি ঋণও আটকে দেয় ব্যাংকটি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকিজ উদ্দিন বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বরাবরের মতোই টাকা তুলে নিতে যাচ্ছিলেন।

ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই আকিজ উদ্দিন নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করতেন। তিনি আমদানি-রফতানির মাধ্যমে এস আলমের কোটি কোটি টাকা পাচারে সহযোগিতা করতেন। বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই অর্থ দিয়েই ইসলামী ব্যাংকের বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এস আলমের বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনতেও সহযোগিতা করতেন। আর এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার নিয়োগ বাণিজ্য। তিনি ইসলামী ব্যাংকে প্রভাব খাটিয়ে পুরনো কর্মরতদের জোরপূর্বক অবসরে বাধ্য করে নতুনভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রতিজন থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিতেন। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক পটিয়া শাখার ম্যানেজার নূরুল কবির, ইউনিয়ন ব্যাংক পটিয়ার শান্তিরহাটের ম্যানেজার নূরুল আলম ও ইসলামী ব্যাংক রাত্তারপুল উপ-শাখার ইনচার্জ জসিম উদ্দিন মিল্টনের মাধ্যমে নিয়োগের কমিশন বাণিজ্য করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাধ্য হয়ে চাকরি হারানো একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত সাত বছরে আকিজের অত্যাচারে ৫০০-এর বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্য ব্যাংকে চলে গেছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন।

আকিজ উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকে ডিএমডি হিসেবে যোগদানের পর পত্রিকায় পাঠানো এক প্রেসবার্তায় তার পঞ্চম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পাসের প্রতিষ্ঠান উল্লেখ থাকলেও স্নাতক বা অন্য ডিগ্রি কোথা থেকে নিয়েছেন তা উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা আকিজ উদ্দিনের অন্য কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন। এমনকি স্নাতক পাস করে ব্যাংকে কোন বছর বা কত বছর আকিজ উদ্দিন কাজ করছেন সে অভিজ্ঞতাও উল্লেখ নেই। অবশ্য তার ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন আছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, দেশের শীর্ষ ব্যাংকের ডিএমডি পদে এ রকম একজন ব্যক্তি ব্যাংকিংখাতের জন্য লজ্জাকর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালে সাইফুল আলম মাসুদের তৎকালীন পিএস নজরুল ইসলামকে সরিয়ে আকিজ উদ্দিন তার পিএস হন। এরপর থেকে আকিজের অভাবনীয় উত্থান! ওই আসনে বসেই শুরু করেন জমির দালালি। দালালি করে রাতারাতি বনে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। সংশ্লিষ্টদের দাবি- পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও চট্টগ্রাম নগরীতে তিন শতাধিক লোক আছেন আকিজের মাসিক বেতনভুক্ত। যারা অল্প টাকা দিয়ে নিজেদের নামে জমি কিনে নেন। পরে রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জমির বাজারমূল্য বহু গুণ বাড়িয়ে আকিজের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেন। পরে ওই টাকা আকিজের মাধ্যমে সাইফুল আলমের পকেটে যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাড়ি ও জায়গা-জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেয়ার পর ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধ হয় না।
এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট একজন জানান, আকিজ উদ্দিনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী থেকে শুরু করে বড় একটি গ্রুপকে মাসোহারা দেয়া হতো। আর এভাবেই তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানটির অতি নিকটের মানুষ হিসেবে অঘোষিত সর্বেসর্বা বনে যান। যে কারণে তার বিরুদ্ধে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ৮-৯টি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউই কথা বলার সাহস রাখতেন না। এই সুযোগে ব্যাংকের সব নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

পটিয়া পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহেব মিয়ার ছেলে আকিজ উদ্দিন এক সময় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এক আত্মীয়ের পেঁয়াজের আড়তে কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন বলেও কথিত আছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করেছে, দেশ থেকে লুটে নেয়া টাকায় দুবাইতে গড়ে তুলেছেন তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দু’টি স্বর্ণের দোকান। যার আনুমানিক মূল্য ৫০০ কোটি। সেগুলো তার শ্যালক পরিচালনা করেন। আকিজের দু’টি জাহাজ রয়েছে রয়েছে বলেও একটি সূত্র দাবি করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। চার হাজার স্কয়ার ফুটের এ ফ্ল্যাটের মূল্য আড়াই কোটি টাকা। চান্দগাঁও আবাসিকে দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার বাজারমূল্য আনুমানিক দেড় কোটি টাকা। পটিয়ায় গ্রামের বাড়িতে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। যার মূল্য তিন কোটি টাকা। নগরের বাকলিয়ায় কল্পলোক আবাসিক এলাকায় রয়েছে আরো একটি ফ্ল্যাট। যার মূল্য দেড় কোটি টাকারও বেশি। চান্দগাঁও আবাসিকে তার ছোট ভাই খোরশেদ আলমের নামে আরো একটি ফ্ল্যাট বাড়ি কিনেছেন। খোরশেদ আলম ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক খুলশী শাখার এসপিও হিসেবে কর্মরত। গত মে মাসে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী এলাকার ৪ নং রোড়ের হাউজ নম্বর ১৭১২-তে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। একই এলাকায় প্লট নম্বর-৩৯/সি অনেক টাকা দিয়ে কিনেছেন। তিনি চারটি প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করেন। যার আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি টাকা। গ্রামের বাড়িতে গেলে একটি বিলাসবহুল কার ব্যবহার করেন। যার মূল্য এক কোটি টাকা। পটিয়ায় নিজের নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল সম্পদ।

অভিযোগ রয়েছে, এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে যে সব ফান্ড ব্যাংক থেকে বের করে নেন, তার মধ্যে একটি অংশ আকিজ উদ্দিন নিজের আয়ত্তে নিয়ে ব্যবহার করেন। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের ব্যাংকগুলোর শাখা ও এটিএম বুথ যখন ওপেন হয় তখন এসব শাখা ও এটিএম বুথের ল্যান্ড লর্ড থেকেও আকিজকে বিপুল অঙ্কের কমিশন দিতে হয়। অন্যথায় চুক্তি সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না।

নিউজটি শেয়ার করুন

এস আলমের হয়ে ব্যাংকের টাকা লুটের ছক আঁকেন আকিজ

আপডেট সময় ০৩:৩৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪

ডিগ্রি পাস করার পর ২০০৯ সালে আকিজ উদ্দিন এস আলম গ্রুপের মালিকাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরই মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের প্রটোকল অফিসার (পিএস) হন। তিনি এস আলমের এস আলমের এতটাই মন জয় করেন যে, ১৪ বছরের ব্যবধানে অস্বাভাবিক পদোন্নতি পেয়ে বনে যান ইসলামী ব্যাংকের মতো দেশসেরা প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। অথচ একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে ডিএমডি পদে আসতে হলে তার অন্তত ২৪-২৬ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তার হাতে। তিনি আর কেউ নন, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন।

জনমুখে এতটাই প্রচারিত যে, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান আকিজ উদ্দিন ব্যাংকের টাকা লুট করে অল্প সময়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, অনেক ধন-সম্পদ, ফ্যাট-প্লট, দেশে-বিদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের দাবি, সফল ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক, সৎ ও দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১২ সালে আকিজ উদ্দিন তার প্রকোটল অফিসারের দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকের টাকা লুটের নানা ছক আকেন। ইসলামী ব্যাংকের ১১ জন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকলেও ব্যাংকের সার্বিক পরিচালনা বা কর্তৃত্বে ছিলেন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দীন ও মোহাম্মদ সাব্বির। এই তিনজনই ব্যাংকের সবকিছু। অন্যরা রুটিন কাজ বা হুকুম পালন করেন মাত্র।

অভিযোগ উঠেছে, গত ৬ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৮৯ কোটি টাকার ‘বেনামি ঋণের’ মাধ্যমে অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ডিএমডি আকিজ উদ্দিন। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের তৎপরতায় ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলন আটকে যায়। এসব অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করছিল আকিজ উদ্দিনের মালিকাধীন ‘গোল্ডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামে দু’টি প্রতিষ্ঠান।

ইসলামী ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় সোনালী, জনতা, রূপালী, পূবালী ও সিটি ব্যাংকে ‘গোল্ডেন স্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি চেক নগদায়নের জন্য পাঠানো হয়। ওই পাঁচটি চেক চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে ৩৪৬ কোটি টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের তৎপরতায় তা আটকে যায়। একই দিন টপ টেন ট্রেডিংয়ের ৫৪৮ কোটি টাকার বেনামি ঋণও আটকে দেয় ব্যাংকটি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকিজ উদ্দিন বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বরাবরের মতোই টাকা তুলে নিতে যাচ্ছিলেন।

ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই আকিজ উদ্দিন নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করতেন। তিনি আমদানি-রফতানির মাধ্যমে এস আলমের কোটি কোটি টাকা পাচারে সহযোগিতা করতেন। বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই অর্থ দিয়েই ইসলামী ব্যাংকের বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এস আলমের বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনতেও সহযোগিতা করতেন। আর এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার নিয়োগ বাণিজ্য। তিনি ইসলামী ব্যাংকে প্রভাব খাটিয়ে পুরনো কর্মরতদের জোরপূর্বক অবসরে বাধ্য করে নতুনভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রতিজন থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিতেন। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক পটিয়া শাখার ম্যানেজার নূরুল কবির, ইউনিয়ন ব্যাংক পটিয়ার শান্তিরহাটের ম্যানেজার নূরুল আলম ও ইসলামী ব্যাংক রাত্তারপুল উপ-শাখার ইনচার্জ জসিম উদ্দিন মিল্টনের মাধ্যমে নিয়োগের কমিশন বাণিজ্য করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাধ্য হয়ে চাকরি হারানো একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত সাত বছরে আকিজের অত্যাচারে ৫০০-এর বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্য ব্যাংকে চলে গেছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন।

আকিজ উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকে ডিএমডি হিসেবে যোগদানের পর পত্রিকায় পাঠানো এক প্রেসবার্তায় তার পঞ্চম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পাসের প্রতিষ্ঠান উল্লেখ থাকলেও স্নাতক বা অন্য ডিগ্রি কোথা থেকে নিয়েছেন তা উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা আকিজ উদ্দিনের অন্য কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন। এমনকি স্নাতক পাস করে ব্যাংকে কোন বছর বা কত বছর আকিজ উদ্দিন কাজ করছেন সে অভিজ্ঞতাও উল্লেখ নেই। অবশ্য তার ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন আছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, দেশের শীর্ষ ব্যাংকের ডিএমডি পদে এ রকম একজন ব্যক্তি ব্যাংকিংখাতের জন্য লজ্জাকর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালে সাইফুল আলম মাসুদের তৎকালীন পিএস নজরুল ইসলামকে সরিয়ে আকিজ উদ্দিন তার পিএস হন। এরপর থেকে আকিজের অভাবনীয় উত্থান! ওই আসনে বসেই শুরু করেন জমির দালালি। দালালি করে রাতারাতি বনে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। সংশ্লিষ্টদের দাবি- পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও চট্টগ্রাম নগরীতে তিন শতাধিক লোক আছেন আকিজের মাসিক বেতনভুক্ত। যারা অল্প টাকা দিয়ে নিজেদের নামে জমি কিনে নেন। পরে রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জমির বাজারমূল্য বহু গুণ বাড়িয়ে আকিজের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেন। পরে ওই টাকা আকিজের মাধ্যমে সাইফুল আলমের পকেটে যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাড়ি ও জায়গা-জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেয়ার পর ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধ হয় না।
এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট একজন জানান, আকিজ উদ্দিনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী থেকে শুরু করে বড় একটি গ্রুপকে মাসোহারা দেয়া হতো। আর এভাবেই তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানটির অতি নিকটের মানুষ হিসেবে অঘোষিত সর্বেসর্বা বনে যান। যে কারণে তার বিরুদ্ধে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ৮-৯টি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউই কথা বলার সাহস রাখতেন না। এই সুযোগে ব্যাংকের সব নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

পটিয়া পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহেব মিয়ার ছেলে আকিজ উদ্দিন এক সময় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এক আত্মীয়ের পেঁয়াজের আড়তে কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন বলেও কথিত আছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করেছে, দেশ থেকে লুটে নেয়া টাকায় দুবাইতে গড়ে তুলেছেন তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দু’টি স্বর্ণের দোকান। যার আনুমানিক মূল্য ৫০০ কোটি। সেগুলো তার শ্যালক পরিচালনা করেন। আকিজের দু’টি জাহাজ রয়েছে রয়েছে বলেও একটি সূত্র দাবি করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। চার হাজার স্কয়ার ফুটের এ ফ্ল্যাটের মূল্য আড়াই কোটি টাকা। চান্দগাঁও আবাসিকে দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার বাজারমূল্য আনুমানিক দেড় কোটি টাকা। পটিয়ায় গ্রামের বাড়িতে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। যার মূল্য তিন কোটি টাকা। নগরের বাকলিয়ায় কল্পলোক আবাসিক এলাকায় রয়েছে আরো একটি ফ্ল্যাট। যার মূল্য দেড় কোটি টাকারও বেশি। চান্দগাঁও আবাসিকে তার ছোট ভাই খোরশেদ আলমের নামে আরো একটি ফ্ল্যাট বাড়ি কিনেছেন। খোরশেদ আলম ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক খুলশী শাখার এসপিও হিসেবে কর্মরত। গত মে মাসে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী এলাকার ৪ নং রোড়ের হাউজ নম্বর ১৭১২-তে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। একই এলাকায় প্লট নম্বর-৩৯/সি অনেক টাকা দিয়ে কিনেছেন। তিনি চারটি প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করেন। যার আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি টাকা। গ্রামের বাড়িতে গেলে একটি বিলাসবহুল কার ব্যবহার করেন। যার মূল্য এক কোটি টাকা। পটিয়ায় নিজের নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল সম্পদ।

অভিযোগ রয়েছে, এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে যে সব ফান্ড ব্যাংক থেকে বের করে নেন, তার মধ্যে একটি অংশ আকিজ উদ্দিন নিজের আয়ত্তে নিয়ে ব্যবহার করেন। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের ব্যাংকগুলোর শাখা ও এটিএম বুথ যখন ওপেন হয় তখন এসব শাখা ও এটিএম বুথের ল্যান্ড লর্ড থেকেও আকিজকে বিপুল অঙ্কের কমিশন দিতে হয়। অন্যথায় চুক্তি সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না।