যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপসাগরীয় সফরের শেষ দিনটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি, আবুধাবিতে ট্রাম্পের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী ‘চুল ছোড়ার’ নাচের আয়োজন করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বহু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী, বিশেষ করে যারা ইউএই’র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জানেন না, তাদের মধ্যে নাচটি নিয়ে বিভ্রান্তি এবং সমালোচনা দেখা যায়।
কিছু ব্যক্তি এই নৃত্যকে ‘বিরক্তিকর’ বা ‘অশ্লীল’ আখ্যা দিয়েছেন, আবার কিছু মন্তব্যকারী এটিকে ‘প্যাগানিজমে’ ফিরে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে, এসব সমালোচনা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আসলে, যে নৃত্যটি ‘চুল ছোড়ার’ নামে পরিচিত, তা ‘আল আইয়ালা’ নামে একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। ‘দ্য ন্যাশনাল’ পত্রিকার ভাষায়, ‘যারা ইউএই-তে কিছু সময়ও কাটিয়েছেন, তাদের কাছে পরিচিত এই ‘হেয়ার ড্যান্স’ বা আসল নাম ‘আল আইয়ালা’, যা সাধারণত মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে।’
এই নৃত্যটির শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত বেদুইন (ভ্রাম্যমাণ আরব জনগোষ্ঠী) ঐতিহ্যে। এটি ইউনেসকো’র ‘মানবতার অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, যা এই সংস্কৃতির গুরুত্বকে তুলে ধরে। এটি ওমানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও ইউএই জুড়ে বিশেষত বিবাহ এবং উৎসব অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।
আল আইয়ালার উৎপত্তি যুদ্ধের অনুকরণ থেকে, যেখানে দুই সারিতে পুরুষেরা একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ায়, হাতে সরু বাঁশের লাঠি থাকে যা বর্শা বা তরবারি বোঝায়। সঙ্গে বাজে ড্রাম, ডাফ (এক ধরনের ড্রাম), ঝাঁঝর এবং পিতলের ঝিনঝিন।
ইউনেসকো ব্যাখ্যা করেছে, ‘এই সারিবদ্ধ পুরুষেরা একসাথে মাথা ও লাঠি দোলায় এবং কাব্যিক গান গায়। এ সময়ে অন্য কিছু পারফর্মার তরবারি বা বন্দুক হাতে সারির চার পাশে ঘোরে এবং মাঝে মাঝে সেগুলো আকাশে ছুড়ে ধরে।’
এটি ইউএই ও ওমানের বেদুইন সংস্কৃতির একটি অংশ, যা ৪০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। ঐতিহাসিকভাবে, এই নৃত্যটি ছিল এক ধরনের যুদ্ধ পুনঃপ্রতিষ্ঠান, যেখানে পুরুষেরা বাঁশের লাঠি দিয়ে সিঙ্ক্রোনাইজডভাবে নাচ করতেন এবং মেয়েরা তাদের দীর্ঘ চুল দুলিয়ে উৎসবের আবহ তৈরি করতেন। এটি সাহস, ঐক্য ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্বব্যাপী এই নাচের সমালোচনা একদিকে যেমন সংস্কৃতির অজ্ঞতা প্রকাশ করে, তেমনি অন্যদিকে ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মানও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য শতাব্দী ধরে একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ, তা নিয়ে সরলীকৃত মন্তব্য করা উচিত নয়। ইউএই এবং ওমানের জনগণ এই নৃত্যকে গর্ব ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরতা ও শক্তি প্রকাশ করেন।
এখন প্রশ্ন উঠছে, কিভাবে একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশুদ্ধভাবে বুঝে সম্মান জানানো যায় এবং কেন কিছু মানুষ তা না বুঝেই সমালোচনা করছেন। এর পাশাপাশি, বিশেষত নারী শিল্পীদের সমালোচনায় যে লিঙ্গগত পক্ষপাতিত্ব রয়েছে, তা নিয়েও একাধিক মন্তব্য সামনে এসেছে।
উল্লেখযোগ্য যে, ইউএই এবং ওমানের বহু লোক একযোগে এই নাচকে তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গর্বিত অনুভব করেন এবং এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর উচিত আরো সচেতন হওয়া।