শিক্ষিকা বোনের প্রভাবে অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম হলেন ছোটভাই

- আপডেট সময় ১১:৪২:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৩৩ বার পড়া হয়েছে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইন ও বিচার বিভাগে পড়ুয়া ভাইয়ের ফলাফল প্রকাশে হস্তক্ষপের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযুক্ত শিক্ষক বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আমেনা খাতুন (আমেনা মমি) এবং তার ভাই ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল মমিন রিফাত। তিনি প্রথমবর্ষে অকৃতকার্য হওয়ায় পরবর্তী ব্যাচের সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যান।
আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে জানা যায়, ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হলে শিক্ষার্থীরা আইন অনুষদের ডীন তাপস কুমার দাস ও সহযোগী অধ্যপক সুপ্রভাত পালের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগে অনাস্থা জ্ঞাপন করেন।
অনতিবিলম্বে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ ও পরীক্ষার ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবীতে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যায়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। যার ফলে উপাচার্য একটি অফিস আদেশের মাধ্যমে অধ্যাপক ড. গোলাম মঈনুদ্দিনকে সভাপতি করে একটি কমিটি করে। যে কমিটি ৪৯, ৫০, ৫১ ও ৫২ ব্যাচের ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের সম্ভাবনা যাচাই করবে।
একই সাথে ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও তাদের স্নাতকোত্তর এর ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানায়। বিভাগসূত্রে জানা গেছে, ৪৮ ব্যাচের ৪৩ জন শিক্ষার্থী ইমেইলযোগে বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বরাবর আবেদন জানায়। গত ২৬/০৯/২৪ তারিখে সবগুলো আবেদনের হার্ডকপিসহ তা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করে ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের নোট পাঠায় বিভাগ। উল্লেখ্য, উক্ত শিক্ষার্থীসহ মোট চারজন পুনর্মূল্যায়নের বিপক্ষে আবেদনপত্র জমা দেন।
এদিকে, বাংলা বিভাগের শিক্ষক আমেনা খাতুন (আমেনা মমি) বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে তার ভাইয়ের রেজাল্ট পুনর্মূল্যায়ন না করে দ্রুত প্রকাশের জন্য ধর্না দেন। তিনি প্রথমে যান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে। কয়েকবার ফলাফলের বিষয়ে জানতে চান এবং কর্মচারীদের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, “রেজাল্ট কেন তৈরি হয় নি এজন্য উনি আমাদের সাথে ব্যাপক উচ্চবাচ্য করেন। হস্তক্ষেপ করেন।”
রেজাল্ট প্রকাশের মাসকয়েক আগেই তার ভাইয়ের স্নাতকোত্তর এর ফলাফল জেনে যান তিনি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থী। রেজাল্ট প্রকাশের আগেই চাপ প্রয়োগ করে রেজাল্ট জানতে চাওয়াকে অনেকে নৈতিক স্খলনের সাথে তুলনা করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে তৎকালীন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক সালাউদ্দিনকে মুঠোফোনে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, আমেনা খাতুন তার ভাইয়ের ফলাফল জানতে এসেছিল। তখন ফলাফল তৈরী হয়নি। পরে আবার এসে ফলাফল জেনে গেছেন এবং উপাচার্য বরাবর লিখা একটি আবেদন পত্র দেখান যেখানে লিখা ছিল ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন যেন না করা হয়। আমি এর পরে কি হয়েছে জানিনা।
রেজাল্ট তৈরি হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যদ্বয়ের সাথে বারবার দেখা করে রেজাল্ট প্রকাশের জন্য চাপ দিতে থাকেন।
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এম মাহফুজুর রহমান আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জানিয়েছেন, আমিনা খাতুন ১০/১২ বার আমার অফিসে এসেছিলেন। আমি বিরক্ত হয়ে তাকে বলেছি আপনি কি পরীক্ষার্থী? যে পরিক্ষার্থী তাকে আসতে বলবেন। বারবার এ বিষয়ে অফিসে আসবেন না।
এছাড়াও তিনি উপাচার্যের সাথে দেখা করে জানান বিভাগের চার জন শিক্ষার্থী পুনর্মূল্যায়ন চায় না যার মধ্যে তার ভাই রিফাতও একজন। তিনি উপাচার্যকে তার ভাই ও অন্য তিন জন শিক্ষার্থীর খাতা যেন পুনর্মূল্যায়ন না করা হয় এই জন্য অনুরোধ করেন।
শিক্ষক আমিনা খাতুন পরীক্ষা পুনর্মূল্যায়ন সম্ভাবনা কমিটির সদস্য গণিত বিভাগের অধ্যাপক আমিনুর রহমান খানের সাথেও দেখা করেন খাতা পুনঃমূল্যায়ন না করার জন্য চাপ দেন।
এ বিষয়ে আমিনুর রহমান খান বলেন,আমার কলিগ আমার সাথে দেখা করতে কথা বলতে আসতেই পারে।আমরা পাশাপাশি থাকি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তবে এই কথা কিভাবে বলতে পারো তিনি খাতা পুনঃমুল্যায়ন না হয় এই জন্য এসেছিল?
‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, সে খাতা পুনমূল্যায়ন যাতে না করা হয় এই বিষয়ে কথা বলতে এসেছিল তবে কমিটি স্বচ্ছতার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে কাজ করবে। আর আমি একা কমিটির কেউ না। কমিটিতে আরো সদস্য আছে তাদের সিদ্ধান্ত এর ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এছাড়াও আমেনা মমির অনুষদের (কলা) ডিন অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হকের মাধ্যমেও রেজাল্ট প্রকাশের জন্য তদবির করতে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইন অনুষদের শিক্ষক জানিয়েছেন, কলা অনুষদের ডিন আইন বিভাগের সভাপতিকে মুঠোফোনে রেজাল্ট প্রকাশের জন্য খবরদারি করেন।
এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমেনা খাতুন নিজে আইন বিভাগের বর্তমান সভাপতি রবিউল ইসলামের সাথে দেখা করে দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল দিতে বলেন।
আইন অনুষদের সভাপতি রবিউল ইসলাম জানান, “আমরা শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। কিন্তু, আমাকে বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে রেজাল্ট দ্রুত প্রকাশ করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে।”
অভিযোগের বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক আমেনা মমি বলেন, আমি অভিভাবক হিসেবে ভাই রেজাল্ট সম্পর্কে জানতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক গিয়েছিলাম। আমি আমার অভিভাবকের দ্বায়িত্ব পালন করেছি এর বাইরে কিছুই না। উপাচার্য অফিসে যাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি অফিশিয়াল কাজে গিয়েছিলাম।
ঐ সময়ে উপস্থিত আমিনা মমির স্বামী পুলিশে কর্মরত রানা জানান, “যে রেজাল্ট প্রকাশ হয় নি সেটি কিভাবে পুনর্মূল্যায়ন হয়। একজনের রেজাল্ট আরেকজন কিভাবে পুনর্মূল্যায়ন চায়?”
কেন পুনর্মূল্যায়ন চান সে বিষয়ে ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাদিয়া মীম ছোঁয়া বলেন, “মূলত সুপ্রভাত পাল আর তাপস কুমার দাস চেয়ারম্যান ও শিক্ষক থাকাকালীন সময় ই তারা এক বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ করে দিত, মূলত যাদের কে তাদের পার্সোনাল কাজে লাগাতে পারতো। এছাড়া বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট এ ইচ্ছা করে কম নাম্বার দিয়ে ধ্বস নামিয়ে দিত। নিজেদের ইচ্ছামাফিক তারা কিছু বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা দিয়েছে।
তবে ৫ আগস্টের পর তাপস কুমার দাস ও সুপ্রভাত পাল পলাতক থাকায় এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানা সম্ভব হয়নি৷