ঢাকা ০৬:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি: বিদেশী মিডিয়া

নিউজ ডেস্ক:-
  • আপডেট সময় ০৩:৩৫:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ১৯১ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরব বিশ্ব মিডিয়া। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, চলমান অচলাবস্থা এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

এর মধ্যে বিবিসির শিরোনাম- বাংলাদেশ ইলেকশন: লুপসাইডেড পোলস লিভ ডিজইল্যুশনড ভোটারস আসকিং হোয়াট ইজ দ্য পয়েন্ট। এতে বলা হয়েছে, নয় সদস্যের পরিবার চালাতে নূর বাশারের প্রতিদিন যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তিনি তার অর্ধেক উপার্জন করতে পারেন। এই অংক প্রতিদিন ৫০০ টাকা।

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধির ফলে এই আয় আরও কমে যেতে পারে। কক্সবাজারে বসবাসরত ৪৩ বছর বয়সী নূর বাশার একজন দিনমজুর। তিনি বলেন, মানুষজন আসলেই দুর্ভোগের শিকার। যদি আমি মাছ কিনি তাহলে সরঞ্জাম কিনতে পারি না। যদি সরঞ্জাম কিনি তাহলে চাল কিনতে পারি না।

রিপোর্টে আর বলা হয়, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। এখানে মানুষজন জীবন ধারনের খরচ মেটাতে সংগ্রাম করছে। একসময়ের প্রতিশ্রুত প্রবৃদ্ধির গ্রাফ এখন নিম্নমুখী। নিম্নভূমির এ দেশটিতে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে আছে। এখানে রোববার যে ভোট হতে যাচ্ছে তাতে হতাশ ভোটাররা কোনো আশা দেখতে পারছেন না।

তারা বলছেন, এ নির্বাচনের ফল জানা। এতে জীবনের কোনো উন্নতি হবে না। নূর বাশার বলেন, আমার প্রধান লক্ষ্য হলো পরিবারের ভরণপোষণ। রাজনীতির তোয়াক্কা আমি করি না। সব সময় ভাবি, কিভাবে ঋণ শোধ করবো। এই ঋণ নিয়েছি বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে। বিবিসি আরও লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দৃশ্যত এই নির্বাচনে তার কর্তৃত্ববাদ আরো কঠোর করছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী হাজার হাজার রাজনীতিক ও সমর্থককে গ্রেপ্তারের পর এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই গ্রেপ্তারকে অধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো নিন্দা জানিয়েছে। তারা একে নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়ার উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করেছে। অনেক ভোটারের দৃষ্টিতে যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিরোধী প্রার্থী নেই তাই এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে গেছে। অনেকের আতঙ্ক শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ মেয়াদে অর্থনীতি আরও খারাপ হবে। হতাশা আরও গভীর হবে।

তাই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একজন নিরাপত্তারক্ষী গিয়াস উদ্দিন বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমার কোনোই আগ্রহ নেই। কেন আমি নির্বাচনের তোয়াক্কা করবো? ফল যাই হোক তা আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন করবে না। তিনি বলেছেন, তার আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে তিনি দিনে পরিবারের জন্য মাত্র দু’বার আহার যোগাড় করতে সক্ষম হন। এখন আর মাছ বা মাংস কিনতে পারেন না। কারণ, এসবের দাম খুব বেশি। তার পরিবার বেঁচে আছে দাতব্য সংস্থার সাহায্য ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণের টাকায়। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমি দুই লাখ টাকা ধার করেছি। কিভাবে এই টাকা ফেরত দেবো জানি না। এ এমন এক কঠিন বিষয়, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় মরে যাওয়া উচিত।

বিবিসি লিখেছে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। অথচ কয়েক বছর আগেও এ দেশটি অর্থনৈতিক জাদু হিসেবে শিরোনাম হয়েছিল। ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতিতে আস্থা ফেরানো হবে পরের সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তা হবে খুবই কঠিন কাজ। কারণ, স্থিতিশীলতা আনতে যে নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে তার জন্য রাজনৈতিক শক্তি থাকবে না সরকারের।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান দেখিয়েছে। নাজুক কর্মপরিবেশ সত্ত্বেও তৈরি পোশাক শিল্প লাখ লাখ পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনতে সাহায্য করেছে। বর্তমান দেশের মোট রপ্তানির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই এই খাতের। কিন্তু ২০২২ সালের মধ্যভাগ থেকে দেশের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। জ্বালানি সংকট ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন হওয়ায় জনগণ রাস্তায় নামতে শুরু করেন। নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল শতকরা প্রায় ৯.৫ ভাগ। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন এই সংখ্যা অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। একসময় আইএমএফ পূর্বাভাস করেছিল যে, বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ ২০২৩ সালে তারা ঝাঁকুনি খাওয়া এই অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসিএলইডি তার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে- দ্য ভায়োলেন্ট পলিটিক্স অব বাংলাদেশজ ২০২৪ ইলেকশন্স। এতে বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মধ্যে সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। ৭ই জানুয়ারি আসন্ন নির্বাচন তার ব্যতিক্রম নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েক মাসে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের জন্য নির্বাচিত হতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সাম্প্রতিক কিছু অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সক্ষমতা ঘিরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়ে আসছে বিএনপি। এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। এর ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রতিবাদ বিক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। যা মাঝেমধ্যেই সহিংস হয়ে ওঠে। নির্বাচন বর্জনে বিএনপির সিদ্ধান্ত এটাই বলে দেয় যে, নির্বাচনের পর সহিংসতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকবে, তাই দলের ভিতরেও সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ আছে। দলের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা দেখা দিতে পারে নির্বাচনের পর।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে দুটি রাজনৈতিক দল। তারা হলো ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ এবং রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী বিএনপি। আদর্শগত পার্থক্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ার খালেদা জিয়ার মধ্যে ব্যকিতগত দ্বন্দ্ব। এজন্য তাদেরকে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের বাইরেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সহিংস প্রতিযোগিতা হয়। ঘন ঘন রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর হামলা হয়। রাজপথে সংঘর্ষ হয়। সরকার বিরোধীদের মধ্যে সহিংস প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলে। এসব সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে ছাত্র, যুব এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোও। এতে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই। এ জন্য বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। দেশজুড়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ আবারও নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফেরে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগের মধ্য দিয়ে। বিরোধীদের ওপর প্রতিশোধ এবং পক্ষপাতমূলক টার্গেট করা চলতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে নির্বাচন সংক্রান্ত এ বিষযগুলোর নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাখ্যান করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আছে।

হুরিয়াত ডেইলি নিউজের শিরোনাম- বাংলাদেশ টু ভোট ইন ইলেকশন উইদাউট অপোজিশন। এত বলা হয়েছে, রোববারের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পঞ্চম মেয়াদ নিশ্চিত করতে ভোট হতে যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেছে, ব্যাপক গণগ্রেপ্তারের কারণে। শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময়ে এক সময়ের দরিদ্র দেশ অসাধারণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। এটা সম্ভব হয়েছে লোভনীয় গার্মেন্ট শিল্পের কারণে। কিন্তু তার এই মেয়াদ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, তার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতাকে খর্ব করে নতুন আইন করা এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্দয় দমনপীড়নের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। নির্বাচনে আসনগুলোতে কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি নেই আওয়ামী লীগ। অল্প কিছু আসনে ছোট দলগুলোকে আসন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা দেখাতে চাইছে নির্বাচন একদলীয় হয়নি। অনেক তরুণ ভোটার বলেছেন, প্রকৃত পছন্দের প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ না থাকার কারণে ভোটে অংশ নেয়ার আগ্রহ নেই তাদের। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রধান বিরোধী দল ও অন্য দলগুলো গত বছর ধারাবাহিক জনসভা করে। দলটি বলছে, দমনপীড়নে বিএনপিসহ বিরোধী প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সরকার বলছে এই সংখ্যা ১১হাজার। আরও হাজার হাজার নেতাকর্মী পালিয়ে আছেন।

বাংলাদেশ বিশ্বেও অষ্টম জনবহুল দেশ। এখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিন রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ২০০৯ সালে ভূমিধস বিজয়ের পর এবার তার বিজয় সুনিশ্চিত। ব্যাপক অনিয়ম এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতা সুসংহত করছেন।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। লন্ডন থেকে তার ছেলে তারেক রহমান বিএনপির হাল ধরে আছেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে নির্বাসনে বসবাস করছেন। দেশে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। তারেক রহমান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, অন্য কয়েক ডজন দলের সঙ্গে তার দল আগে থেকে ফল নির্ধারিত এমন ভোটে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি: বিদেশী মিডিয়া

আপডেট সময় ০৩:৩৫:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৪

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরব বিশ্ব মিডিয়া। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, চলমান অচলাবস্থা এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

এর মধ্যে বিবিসির শিরোনাম- বাংলাদেশ ইলেকশন: লুপসাইডেড পোলস লিভ ডিজইল্যুশনড ভোটারস আসকিং হোয়াট ইজ দ্য পয়েন্ট। এতে বলা হয়েছে, নয় সদস্যের পরিবার চালাতে নূর বাশারের প্রতিদিন যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তিনি তার অর্ধেক উপার্জন করতে পারেন। এই অংক প্রতিদিন ৫০০ টাকা।

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধির ফলে এই আয় আরও কমে যেতে পারে। কক্সবাজারে বসবাসরত ৪৩ বছর বয়সী নূর বাশার একজন দিনমজুর। তিনি বলেন, মানুষজন আসলেই দুর্ভোগের শিকার। যদি আমি মাছ কিনি তাহলে সরঞ্জাম কিনতে পারি না। যদি সরঞ্জাম কিনি তাহলে চাল কিনতে পারি না।

রিপোর্টে আর বলা হয়, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। এখানে মানুষজন জীবন ধারনের খরচ মেটাতে সংগ্রাম করছে। একসময়ের প্রতিশ্রুত প্রবৃদ্ধির গ্রাফ এখন নিম্নমুখী। নিম্নভূমির এ দেশটিতে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে আছে। এখানে রোববার যে ভোট হতে যাচ্ছে তাতে হতাশ ভোটাররা কোনো আশা দেখতে পারছেন না।

তারা বলছেন, এ নির্বাচনের ফল জানা। এতে জীবনের কোনো উন্নতি হবে না। নূর বাশার বলেন, আমার প্রধান লক্ষ্য হলো পরিবারের ভরণপোষণ। রাজনীতির তোয়াক্কা আমি করি না। সব সময় ভাবি, কিভাবে ঋণ শোধ করবো। এই ঋণ নিয়েছি বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে। বিবিসি আরও লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দৃশ্যত এই নির্বাচনে তার কর্তৃত্ববাদ আরো কঠোর করছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী হাজার হাজার রাজনীতিক ও সমর্থককে গ্রেপ্তারের পর এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই গ্রেপ্তারকে অধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো নিন্দা জানিয়েছে। তারা একে নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়ার উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করেছে। অনেক ভোটারের দৃষ্টিতে যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিরোধী প্রার্থী নেই তাই এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে গেছে। অনেকের আতঙ্ক শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ মেয়াদে অর্থনীতি আরও খারাপ হবে। হতাশা আরও গভীর হবে।

তাই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একজন নিরাপত্তারক্ষী গিয়াস উদ্দিন বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমার কোনোই আগ্রহ নেই। কেন আমি নির্বাচনের তোয়াক্কা করবো? ফল যাই হোক তা আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন করবে না। তিনি বলেছেন, তার আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে তিনি দিনে পরিবারের জন্য মাত্র দু’বার আহার যোগাড় করতে সক্ষম হন। এখন আর মাছ বা মাংস কিনতে পারেন না। কারণ, এসবের দাম খুব বেশি। তার পরিবার বেঁচে আছে দাতব্য সংস্থার সাহায্য ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণের টাকায়। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমি দুই লাখ টাকা ধার করেছি। কিভাবে এই টাকা ফেরত দেবো জানি না। এ এমন এক কঠিন বিষয়, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় মরে যাওয়া উচিত।

বিবিসি লিখেছে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। অথচ কয়েক বছর আগেও এ দেশটি অর্থনৈতিক জাদু হিসেবে শিরোনাম হয়েছিল। ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতিতে আস্থা ফেরানো হবে পরের সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তা হবে খুবই কঠিন কাজ। কারণ, স্থিতিশীলতা আনতে যে নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে তার জন্য রাজনৈতিক শক্তি থাকবে না সরকারের।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান দেখিয়েছে। নাজুক কর্মপরিবেশ সত্ত্বেও তৈরি পোশাক শিল্প লাখ লাখ পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনতে সাহায্য করেছে। বর্তমান দেশের মোট রপ্তানির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই এই খাতের। কিন্তু ২০২২ সালের মধ্যভাগ থেকে দেশের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। জ্বালানি সংকট ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন হওয়ায় জনগণ রাস্তায় নামতে শুরু করেন। নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল শতকরা প্রায় ৯.৫ ভাগ। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন এই সংখ্যা অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। একসময় আইএমএফ পূর্বাভাস করেছিল যে, বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ ২০২৩ সালে তারা ঝাঁকুনি খাওয়া এই অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসিএলইডি তার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে- দ্য ভায়োলেন্ট পলিটিক্স অব বাংলাদেশজ ২০২৪ ইলেকশন্স। এতে বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মধ্যে সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। ৭ই জানুয়ারি আসন্ন নির্বাচন তার ব্যতিক্রম নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েক মাসে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের জন্য নির্বাচিত হতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সাম্প্রতিক কিছু অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সক্ষমতা ঘিরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়ে আসছে বিএনপি। এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। এর ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রতিবাদ বিক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। যা মাঝেমধ্যেই সহিংস হয়ে ওঠে। নির্বাচন বর্জনে বিএনপির সিদ্ধান্ত এটাই বলে দেয় যে, নির্বাচনের পর সহিংসতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকবে, তাই দলের ভিতরেও সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ আছে। দলের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা দেখা দিতে পারে নির্বাচনের পর।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে দুটি রাজনৈতিক দল। তারা হলো ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ এবং রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী বিএনপি। আদর্শগত পার্থক্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ার খালেদা জিয়ার মধ্যে ব্যকিতগত দ্বন্দ্ব। এজন্য তাদেরকে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের বাইরেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সহিংস প্রতিযোগিতা হয়। ঘন ঘন রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর হামলা হয়। রাজপথে সংঘর্ষ হয়। সরকার বিরোধীদের মধ্যে সহিংস প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলে। এসব সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে ছাত্র, যুব এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোও। এতে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই। এ জন্য বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। দেশজুড়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ আবারও নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফেরে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগের মধ্য দিয়ে। বিরোধীদের ওপর প্রতিশোধ এবং পক্ষপাতমূলক টার্গেট করা চলতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে নির্বাচন সংক্রান্ত এ বিষযগুলোর নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাখ্যান করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আছে।

হুরিয়াত ডেইলি নিউজের শিরোনাম- বাংলাদেশ টু ভোট ইন ইলেকশন উইদাউট অপোজিশন। এত বলা হয়েছে, রোববারের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পঞ্চম মেয়াদ নিশ্চিত করতে ভোট হতে যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেছে, ব্যাপক গণগ্রেপ্তারের কারণে। শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময়ে এক সময়ের দরিদ্র দেশ অসাধারণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। এটা সম্ভব হয়েছে লোভনীয় গার্মেন্ট শিল্পের কারণে। কিন্তু তার এই মেয়াদ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, তার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতাকে খর্ব করে নতুন আইন করা এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্দয় দমনপীড়নের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। নির্বাচনে আসনগুলোতে কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি নেই আওয়ামী লীগ। অল্প কিছু আসনে ছোট দলগুলোকে আসন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা দেখাতে চাইছে নির্বাচন একদলীয় হয়নি। অনেক তরুণ ভোটার বলেছেন, প্রকৃত পছন্দের প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ না থাকার কারণে ভোটে অংশ নেয়ার আগ্রহ নেই তাদের। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রধান বিরোধী দল ও অন্য দলগুলো গত বছর ধারাবাহিক জনসভা করে। দলটি বলছে, দমনপীড়নে বিএনপিসহ বিরোধী প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সরকার বলছে এই সংখ্যা ১১হাজার। আরও হাজার হাজার নেতাকর্মী পালিয়ে আছেন।

বাংলাদেশ বিশ্বেও অষ্টম জনবহুল দেশ। এখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিন রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ২০০৯ সালে ভূমিধস বিজয়ের পর এবার তার বিজয় সুনিশ্চিত। ব্যাপক অনিয়ম এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতা সুসংহত করছেন।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। লন্ডন থেকে তার ছেলে তারেক রহমান বিএনপির হাল ধরে আছেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে নির্বাসনে বসবাস করছেন। দেশে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। তারেক রহমান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, অন্য কয়েক ডজন দলের সঙ্গে তার দল আগে থেকে ফল নির্ধারিত এমন ভোটে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।