জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ ও তারুণ্যের ভাবনা

- আপডেট সময় ১২:১৯:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
- / ৬৩ বার পড়া হয়েছে
১৯ জুলাই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ। সকল গণহত্যার বিচার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র সহ ৭ দফা দাবিতে আয়োজন হয়েছে এই সমাবেশ। বিভিন্ন সূত্রমতে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছে এই সমাবেশে। এক ঐতিহাসিক মুহুর্তের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরে নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দলটিকে। এখনো যেন প্রশ্ন ও কৌতুহলের অন্ত নেই। এর মধ্যেও এত বড় সমাবেশ সেই বিতর্কের প্রশ্নকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।
এই জনস্রোত ভিন্ন কিছু বলে। বার্তা দেয় এক নতুন বাংলাদেশের। ট্যাগিংয়ের রাজনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই তো প্রতিষ্ঠা হয়েছে চব্বিশের নব-অভ্যুত্থান! এই অভ্যুত্থানের সম্মুখ-সারির যোদ্ধা তথা তরুণ প্রজন্মের জন্য কী বার্তা রয়েছে এই সমাবেশে, আসুন উদঘাটন করার চেষ্টা করি।
জাতীয় সমাবেশে ঘোষিত ৭ টি দফা ছিল-
১. সকল গণহত্যার বিচার
২. প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার
৩. জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন
৪. শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন
৫. পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান
৬. প্রবাসীদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা এবং
৭. লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ
উত্থাপিত ৭ দফা দাবির সিংহভাগই তরুণদের প্রাণের চাওয়া। ’২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের অগ্রসেনানী ছিল এই তরুণরা। বুলেটের সামনে নির্দ্বিধায় বুক পেতে দিয়ে, তাজা রক্ত জমিনে ঢেলে জাতির গর্দান থেকে ১৬ বছরের জুলুম-পীড়নের জিঞ্জির ছিন্ন করে এক নতুন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে এই তরুণ প্রজন্ম।জামায়াতে ইসলসামীর সমাবেশে তাই তারুণ্যের কণ্ঠই উচ্চকিত হয়েছে বারবার। নতুন স্বাধীনতার অঙ্গীকার হচ্ছে জুলাইসহ সকল গণহত্যার বিচার নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন এবং শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। জাতীয় সমাবেশে মোটাদাগে এই কয়টি বিষয়ে জোরালো দাবি উঠেছে। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে সমাবেশে রাজনীতিবিদদের চাইতেও তরুণ জুলাই যোদ্ধাদের কন্ট্রিবিউশন ছিল চোখে পড়ার মতো।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, আলিয়া মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসা; অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সকল পক্ষ থেকেই তরুণ জুলাই যোদ্ধারা তাদের অবদান ও দাবি উত্থাপন করেছেন বলিষ্ঠতার সাথে। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে জুলাইয়ের স্পিরিট, তেজোদীপ্ত কণ্ঠে তাঁরা ঘোষণা করেছেন- এ লড়াইয়ের প্রধান শক্তি ছিল আল্লাহর সাহায্য। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই যোদ্ধা এম এস মোস্তাফিজুর রহমান স্পষ্টভাবে বারবার একথার সাক্ষী দিয়েছেন-“এই ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে আমরা সক্ষম হয়েছি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে। আমাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই, যদি আল্লাহ আমাদের উত্তম সাহায্যকারী না হন।” এ যেন সমস্ত তাওহীদবাদীদের এক বিপ্লবী কণ্ঠস্বর।
সমাবেশে জুলাই গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে সবাই দৃঢ়চেতা মনোভাব দেখিয়েছেন। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শহীদ আবরার ফাহাদের সম্মানিত পিতা দাবি তুলেছেন-শুধু জুলাই নয়, ক্যাম্পাসে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদেরও তালিকা করার, তাদের জন্যও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার। ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জুলাই মাসের মধ্যেই জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতিস্বরূপ জু্লাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের জোর দাবী জানান। দাবি জানান জুলাই গণহত্যার বিচারের। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রমের সমালোচনা সহ তরুণ প্রজন্মকে সন্ত্রাস ও মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা ও সকল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করেন। তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন-“প্রয়োজনে আবার জীবন দিবো, আবার রক্ত দিবো, আবার জুলাই ফিরে আসবে; কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা কোনো ফ্যাসিবাদের হাতে তুলে দিবো না ইনশাআল্লাহ।”
ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল জুলাই মাসেই জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। আহ্বান করেন শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনেরও। সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থেকে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য দৃঢ় কদমে সর্বশক্তি বিনিয়োগ করে এগিয়ে যাওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। তারুণ্যের এই বজ্রকণ্ঠ নিঃসন্দেহে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রেরণা যোগাবে বলে প্রত্যাশা সকলের।
আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান তরুণদেরকে হৃদয়ের গভীর থেকে ধারণ করেন। তাঁর বক্তব্যে তাও ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। তাঁর ভাষায়-“আমি শিশুদের বন্ধু, তরুণদের ভাই, বৃদ্ধদের সহযোদ্ধা।” কী সম্মোহনী শব্দচয়ন! কতটা অনুপ্রেরণাদায়ক তাঁর এই অভিব্যক্তি। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি জুলাই যোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন। হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা দিয়ে তাঁদেরকে বীরের মর্যাদায় তুলে ধরেছেন। শুধু কথায়ই নয়, অসুস্থ হয়ে দুই-দুইবার মাটিতে লুটিয়ে পড়েও উঠে দাঁড়ানোর যে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, জনগণের প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা, তা তরুণ প্রজন্মসহ পুরো জাতির জন্যই প্রেরণাদায়ক।
এতবড় একটি সমাবেশের শৃঙ্খলা তরুণদের চিন্তা ও মননকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। উদ্যান সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাইক স্থাপন না করা, ক্যাম্পাস এরিয়ায় সমাবেশে আগতদের কোনো গাড়ি প্রবেশ না করা, অনুষ্ঠান শেষে ক্যাম্পাস ও মাঠে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জামায়াতে ইসলামীকে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে নিশ্চয়ই।
সমাবেশস্থল ছাড়িয়ে আশেপাশের রাস্তাগুলো যখন লোকে লোকারণ্য, সেই সময়ে ঢাকার বাসিন্দাদের স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটা বেশ চ্যালেঞ্জের। ‘নূর হাবিবা অনন্যা’ নামক এক নারীর নিরাপদে রাস্তা চলাচল ও সমাবেশে আগতদের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানের সহিত সম্বোধন করা ও রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করার যে অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন, তাতে আগামীর বাংলাদেশে জামায়াতের নেতৃত্ব যে কত কল্যাণমুখী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়-“রাজনীতিকে বরাবরই অন্ধকার জায়গা মনে হয় আমার। কিন্তু কাল আমিরের অসুস্থতায় মন থেকে দু’য়া করেছি। এই দলের ভিতরে কি আছে না আছে জানিনা আমি কিন্তু দলটা কিছু মানুষকে ভদ্র বানাতে পেরেছে কিংবা ভদ্র আল্লাহভীরু কিছু মানুষকে দলে নিতে পেরেছে। ভীড়ে একটা মেয়েকে নিরাপদ অনুভব করাতে পেরেছে, এটা অনেক বড় ব্যাপার। একটু কম বলা হলো বোধ হয়!! এটা অনেক অনেক অনেক বড় একটা ব্যাপার..!!” জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় আসলে নারীদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে, এই ফোবিয়ায় ভোগেন অনেকেই, সেই সংশয়ও দূর হয়েছে এই সমাবেশ থেকে।
সমাবেশ শুরুর আগে নান্দনিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার এক চমৎকার মাধ্যম। জুলাই আন্দোলনে প্রেরণাদায়ক ‘আয় তারুণ্য আয়’, ‘জেগেই যখন উঠেছ বন্ধু’, ‘এই আন্দোলন সফল হবে সাহস রাখো যদি’, ‘বইছে বাতাস বৈরি তৈরি থেকো তৈরি’-ইত্যাদি গানগুলো তারুণ্যকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে। সাথে ছিল বৈচিত্রময় নাটিকা, জারি গান ও গম্ভীরার মতো ক্লাসিক্যাল পরিবেশনা। বৈচিত্রময় সংস্কৃতির মিল-মিশেলে এক অনন্য আয়োজন উপহার দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাংস্কৃতিক উইং। একই সাথে নজর কেড়েছে প্রতিভাবান ডাক্তারদের নিয়ে গঠিত ‘ন্যাশনাল ডক্টর’স ফোরাম (এনডিএফ )’ এর মেডিকেল সেবা।
একজন তরুণ জুলাই যোদ্ধা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের দৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের পর্যালোচনা তরুণদের জন্য এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। তাঁর ভাষায়-“লাখ লাখ মানুষ। কাউকে অমনোযোগী পাওয়া যায়নি। স্বেচ্ছাসেবকরা কাউকে আঘাতও করেননি। জামায়াত ইসলামী ব্যতীত কোন নেতার ব্যক্তিগত কোন ছবি, পোস্টার দেখা যায়নি। আমার মত মাথায় দেশের পতাকা বাঁধা তরুণ দেখলাম অসংখ্য। বিভিন্ন দলের এতজন বক্তৃতা দিলেন কিন্তু বিপক্ষ কারও প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ কিছু বলেননি। এমনকি ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা আজহারুল ইসলামকেও দেখলাম শালীনভাবে কথা বলতে!!”
সার্বিক পর্যালোচনা শেষে তিনি বলেন- “রাজনীতির ধরণ পাল্টাচ্ছে- এটাই আমার বড় সান্তনা। সাথে দেখলাম প্রায় ৭০ বছর বয়সী নেতার (আমীরে জামায়াত) ঈমানী শক্তি। আল্লাহু আকবার। ফেরার পথে দেখলাম লাখ লাখ লোক আবার নিরবে যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন। কোন বিশৃঙ্খলা নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ-সবাই যেন নিয়মের বাঁধনে আটক হয়ে যেভাবে এসেছেন আবার ঠিক একই ভাবে ফিরে গেলেন। কেন যেন মনে হচ্ছে বিপ্লব আরেকটা হবে। তবে সেটা নিরবে; দাঁড়িপাল্লার।”
তরুণ প্রজন্ম তথাকথিত পেশিশক্তির রাজনীতি আর দেখতে চায় না। দেখতে চায় না হানাহানির রাজনীতিও। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সম্মানবোধের এ নয়া রাজনীতির চিত্র তরুণরা দেখতে চায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের এই সমাবেশ। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আগামীর সমৃদ্ধ ও কল্যাণমূলক বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণরা এগিয়ে আসবে বলেই প্রত্যাশা। তরুণদের পদচারণার মুখর হোক গণমানুষের সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। স্বপ্নবাজ তরুণদের নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশ হয়ে উঠুক সুখী, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি