এমতাবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রী ভোটে হেরে গেলে তাতে আওয়ামী লীগ ক্ষতি দেখছে না
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কোথাও নিজেরা, কোথাও ঘনিষ্ঠরা
- আপডেট সময় ০৩:৪১:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৪
- / ১৬৬ বার পড়া হয়েছে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ আগামীকাল রোববার। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগই প্রধান দল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।
এর বাইরে ক্ষমতাসীন দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক, মিত্র এবং ঘনিষ্ঠ কিছু দলও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আর কিছু আসনে বিএনপির দলছুট নেতা এবং ‘কিংস পার্টি’ বলে পরিচিত কয়েকটি দলের প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের প্রায় সবাই ভোটে এসেছেন আওয়ামী লীগ ও সরকার–ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন মহল থেকে সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে।
এ নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সর্বশেষ যে চিত্র, তাতে এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে ৭ জানুয়ারির ভোটে যে সংসদ গঠিত হতে যাচ্ছে, এর সদস্যদের বড় অংশই হবে আওয়ামী লীগের নেতা ও দলটির সমর্থক। বাকিরাও আসছেন আওয়ামী লীগ ও সরকার–ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতদের মধ্য থেকে। অর্থাৎ আগামী সংসদ এক দলের সমর্থকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ যে ২৮টি দল অংশ নিয়েছে, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা আছেন ২৬৬ আসনে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আরও ২৬৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব আসনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থীদের সরিয়ে নিয়েছে। ১৪–দলীয় শরিকেরা সমঝোতার মাধ্যমে ছয়টি আসন পেয়েছে। এর মধ্যে জাসদ তিনটি, ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি ও জাতীয় পার্টি (জেপি) একটি আসন পেয়েছে। এসব আসনে তাঁরা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করছেন।
ভোটের আগে নিবন্ধন পেয়ে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও সুপ্রিম পার্টি এবং বিএনপির দলছুট কিছু নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদপন্থী ১৬ জন নেতা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কিংস পার্টি, বিএনপির দলছুট ও রওশনপন্থী প্রার্থী মিলে অন্তত ১৫ জনকে জিতিয়ে আনতে সরকার–ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো মহল তৎপর রয়েছে বলে মাঠপর্যায় থেকে জানা গেছে। ইতিমধ্যে এসব প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নেমেছেন।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, দলটির যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবারই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, দলটির উপকমিটি কিংবা তৃণমূলের কোনো না কোনো পর্যায়ে দলীয় পদ রয়েছে। কেউ কেউ আছেন আওয়ামী লীগ–সমর্থক পেশাজীবী নেতা ও ব্যবসায়ী। নির্বাচনের মাঠে তাঁদের কর্মী, সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকেরাও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্যরা এক বা একাধিক পছন্দের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নানাভাবে ভূমিকা রাখছেন।
এবারের নির্বাচনকে বিদেশি গণমাধ্যম ‘একতরফা’ বলছে—এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা একতরফা নির্বাচন নয়; বরং একতরফা বিরোধিতা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের তেজগাঁও কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা একটা ভালো ইলেকশন হবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি থাকলে ইলেকশনটা মোর কম্পিটিটিভ হতো। বিএনপি নেই, তারপরও নির্বাচনটা প্রতিযোগিতামূলক হবে।’
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। শুরুতেই ধারণা করা হচ্ছিল, বেশির ভাগ আসনে আওয়ামী লীগই জিতবে। তবে কমবেশি ১০০ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে নৌকার প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। ভোটের এক দিন আগে আওয়ামী লীগের বিশ্লেষণে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই চিত্রের খুব একটা বদল হয়নি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র বলছে, অন্তত ৭০ আসনে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী। বাকি ৩০টি আসনে জাপা, ১৪ দলের শরিক, বিএনপি থেকে ছেড়ে আসা নেতা বা ‘কিংস পার্টি’র প্রার্থীরা এবং জাপার রওশনপন্থী নেতারা অন্যদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন বলে ধারণা করা হয়। বাকি ২০০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি কমে যায় কি না, এ নিয়ে অস্বস্তি আছে আওয়ামী লীগে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরের আসনগুলো রয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন হচ্ছে, দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৫০–এর বেশি আসনে জিততে পারেন।
আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় পার্টিকে (জাপা) যে ২৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর ১৫টির মতো আসনে জাপার প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন। ১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হলেও সব কটিতে তারা জিততে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর বাইরে ১৫টির মতো আসনে কিংস পার্টি ও বিএনপির দলছুট নেতাদের মধ্য থেকে ১০ জনকে জিতিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার–ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো মহলের তৎপরতা রয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দলীয় স্বতন্ত্র, জাপা, রওশন সমর্থক প্রার্থী, ১৪ দলের শরিক ও বিএনপির দলছুট—সব মিলিয়ে ৭৫টির মতো আসনে জয়ী হতে পারে। দুই শতাধিক আসনে নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য ও একাধিকবার জয়ী হয়েছেন, এমন অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন। এঁদের মধ্যে পিরোজপুর, সিলেট, গাজীপুর, সাভার, নাটোর ও রাজশাহীর কয়েকজন রয়েছেন।
যদিও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এটা নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবার বড় লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই বড় ভরসা। এমতাবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রী ভোটে হেরে গেলে তাতে আওয়ামী লীগ ক্ষতি দেখছে না। বরং এটাকে উল্লেখ করে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে আওয়ামী লীগ প্রচার চালাতে পারবে।
ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু কৌশলের কারণে ভোটের মাঠে জটিলতাও তৈরি করেছে। ‘স্বতন্ত্র কৌশল’–এর কারণে প্রায় প্রতিদিনই সংঘাত-মারামারি হচ্ছে। এরই মধ্যে শতাধিক স্থানে সহিংসতা হয়েছে। মারা গেছেন অন্তত তিনজন।
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে স্বস্তিতে নেই দলটির জোটের শরিক ও মিত্ররা। কারণ, আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় পেলেও অনেক আসনে দলটির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন। এমতাবস্থায় ১৪ দলের শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা বারবার মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সহায়তা চাইছেন বলে আওয়ামী লীগ ও জোট সূত্র থেকে জানা গেছে।
শরিক আরেকটি দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বিএনপির সহায়তা চেয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বলেও আলোচনা আছে।
জাপা সূত্র জানিয়েছে, তাদের নেতাদেরও অনেকের ঝুঁকি রয়েছে। মূলত আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীই তাঁদের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন।
বিএনপির দলছুট স্বতন্ত্র প্রার্থী, কিংস পার্টির নেতা ও জাপার রওশনপন্থী প্রার্থীদের বেলায় চিত্রটা ভিন্ন। এসব আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা উল্টো চাপে রয়েছেন।
এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকে নেমেছেন। এই আসনে সাবেক আইজিপি ও বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পেয়েছেন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন।
একই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিন। নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র; দুজনই অভিযোগ করেছেন, একটি বিশেষ মহল আখতারুজ্জামানের পক্ষে কাজ করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চাপ দিচ্ছে।
কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদ ঋণখেলাপির জন্য বাদ পড়েন। বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তাঁকেই নেতা–কর্মীরা দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি জাফর আলমের কর্মীদের অনেকেই এখন এলাকাছাড়া হয়েছেন বলে তাঁর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
সিলেটের একটি আসনে আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশকে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগের প্রার্থী চারবারের সংসদ সদস্য।
সিলেটের আরেকটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন একজন ধর্মীয় নেতা। তাঁর পক্ষেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামানো হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
এবারের নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, অনেক দেশে দু-তিনটি দলের মধ্যে ভোট হয়। এখানে ২৮টি দল অংশ নিচ্ছে। এখন কারা ভোট বর্জন করেছে আর অংশ নিচ্ছে, সেটা বিবেচনায় নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বরং ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারছেন কি না, সেটাতেই গুরুত্ব দিচ্ছে।