স্কুলের পাঠ্যবইয়ে উপস্থাপিত ইতিহাস নিয়ে শঙ্কা কেন?
- আপডেট সময় ০৩:২৫:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ২৬১২ বার পড়া হয়েছে
একটা বড় ধরনের শঙ্কা ও মোটাদাগে দুই ধরনের সংকট আছে এ বছরের উপস্থাপিত স্কুলের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে।
সংকটগুলো হলো- প্রথমত, এই ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের যে অনুচ্ছেদগুলোর বিবরণ- তা বাংলাদেশের স্থানিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় সকল স্কুলে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, হতে পারে তা উপায়-উপকরণের অভাব, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব কিংবা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবেশিক কারণে।
দ্বিতীয়ত, ইতিহাস রচনায় যারা এ দেশের বিদগ্ধজন, প্রথিতযশা, বিশেষজ্ঞ, এবং যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের পরামর্শ, মতামত না নিয়ে, বরং একজন গবেষকের- যিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যিনি পরিচিত নন, তাঁর লিখিত ও দেশের জার্নালে প্রকাশিত বয়ানকে অবলম্বন করা হয়েছে ইতিহাস বর্ণনায়।দ
যার বয়ানের বিষয়ে এখনো দেশের অধিকাংশ গবেষক, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ একমত হয়েছেন তার আলামত পাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে যে বিষয়টি শঙ্কা তৈরি করেছে তা হলো- ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণির আত্মপরিচয়ের অধ্যায়ে যেভাবে নিজেদের আত্মপরিচয় উপস্থাপন করা হয়েছে সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশের যে নতুন ইতিহাস নির্মাণের বিতর্কিত বয়ান, সেটির অনুরূপ আভাস পাওয়া যায় আমাদের পাঠ্য বইয়ে।
এর পাশাপাশি অতীতের কালানুক্রম ইতিহাস বর্ণনাকে অনুসরণ না করে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের ইতিহাস হৃদয়াঙ্গমে মুশকিলে ফেলবে। বরং আমাদের এই ভূ-খণ্ডে মৌর্য, শুঙ্গ, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানি, মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই সময়কালে বিভিন্ন স্থানকে ঘিরে যে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত, উৎস, প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বিস্তৃত আলোচনার পরিবর্তে বিক্ষিপ্ত ও সীমিত আলোচনা করা হয়েছে।
ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য এ ভূখণ্ডের ইতিহাস অজানা থেকে যাবে। অজানা থাকবে অতীতে এ ভূ-খণ্ডে বিভিন্ন শাসক, শোষিত, জনসাধারণের কালানুক্রমিক ইতিহাস। অথচ একটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জরুরি হলো সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত শত্রু-মিত্রকে চিন্তে পারা। ঘটে যাওয়া বিগত সময়ের ঘটনা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা থাকা। তাহলেই কেবল নতুন প্রজন্ম অতীত জ্ঞান থেকে ভবিষ্যতের সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারবে। প্রাচীন বাংলাদেশের ইতিহাসের বদলে হঠাৎ করে বাংলাদেশ নির্মাণের যে চেষ্টা তা শিক্ষার্থীদের, ও দীর্ঘমেয়াদে একটা জাতিকে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচের পরিবর্তে শেকড়বিহীন জাতিতে পরিণত করতে পারে।
৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে বর্ণিত ইতিহাসকে বাংলাদেশের ইতিহাস বলার চেয়ে বইয়ে ‘বাংলা অঞ্চল’ নামের একটি ভূখণ্ডের কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা হয়েছে। মানচিত্রেও বারবার দেখানো হয়েছে বাংলা অঞ্চলকে। যার সংযোগ ঘটেছে অখণ্ড ভারতের মানচিত্রের সঙ্গে। মুশকিল হলো এ ধরনের ভূ-খণ্ডের পরিচয় আমাদের এর অনেক আগে করিয়েছেন হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকার। লন্ডনে থাকাকালীন বিনায়ক দামোদর সাভারকর যিনি ইউজেনেক্স মুভমেন্ট দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এমনকি তিনি নাৎসিবাদের প্রতিও তুষ্ট ছিলেন। তিনিই প্রথম চেয়েছিলেন সব ধর্ম ও আদর্শের উপরে উঠে সবাই নিজেকে আগে ভারতীয় ভাবুক। সাভারকরের ভাবনার অনুরূপ পাঠ্যবইয়ের সেই কল্পিত মানচিত্রের বিষয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ের ৫১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘এই বাংলা অঞ্চল আর আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়। বাংলা অঞ্চলেরই পূর্ব অংশে আমরা বাস করি। আবার এই ধরে নেওয়া বাংলা অঞ্চলকে যুক্ত করা হয়েছে অখণ্ড ভারতের পূর্বাংশে।’ বইয়ের উপস্থাপিত এই বাংলা অঞ্চলকে আবার এমনভাবে বর্ণনা ও মানচিত্রে দেখানো হয়েছে যা দেখে যেকেউ মনে করবে এটা অখণ্ড ভারত থেকে পাওয়া একটা অংশ। আবার ৭ম শ্রেণির বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় বাংলা অঞ্চল ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের পূর্ব অংশ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
৬ষ্ঠ শ্রেণির বই এর ৬৬ পৃষ্ঠায়, আরও খোলামেলা করে বলা হয়েছে- ‘ইতিহাসের আলোকে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রাচীনকালে যে ভূখণ্ড ভারতবর্ষ নামে পরিচিত ছিল সেই ভূখণ্ড এখন দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশ নামে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে মোট আটটি রাষ্ট্র রয়েছে। এগুলো হলো- আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপ।’ তাঁর মানে যেকেউ বুঝবে যে ভারতবর্ষের এই সীমা-পরিসীমা, আমাদের মস্তিস্কে অখণ্ড ভারতবর্ষের চিত্র চিত্রিত করে। হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা দামোদর সাভারকারের দেয়া বয়ানের সাথে এই বয়ান মিলে যাওয়ায় যে বড় শঙ্কা তৈরি হয়, সে বিষয়ে একটু আলাপ করি-
ড. সুকান্ত দাস, যিনি কর্মসূত্রে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (আইআইএসটি), শিবপুরে অধ্যাপনা করেন। তিনি করোনা সময়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কিভাবে বর্তমানে আরএসএস সংঘ ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়ার এবং হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজে তৎপর। তারা তাদের ভারতবর্ষ তত্ত্বকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করেছে। ইন্ডিয়ার স্কুল পাঠ্যসূচি থেকে রোমিলা থাপার, আরএস শর্মা, বিপান চন্দ্র প্রমুখদের তাদের প্রণীত যে পাঠ্যবই ছিল সেখান থেকে মধ্যযুগ, আদি থেকে গরুর মাংস খাওয়ার ইতিহাসগুলো সরিয়ে ফেলেছে এর পরিবর্তে ভারতের পাঠ্য বইয়ের বর্তমান টার্গেট পুরাণকে ইতিহাসের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া, ব্রাহ্মণ্যবাদকে তুলে ধরা আর মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের প্রতি বিদ্বেষ ছুঁড়ে দেওয়া। এজন্য তারা নতুন ইতিহাস লেখার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে এমন মানুষদের- যারা ইতিহাস বিষয়ে দক্ষ কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত নয়। ঠিক সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে পাঠ্যবইয়ের পুরো প্যাটার্ন পরিবর্তন করে ফেলা এবং পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিকদের সাথে উন্মুক্ত আলোচনা না করে সরাসরি আগের সকল সিলেবাসগুলোকে পরিবর্তন অনুরূপভাবে আমাদের দেশেও ঘটেছে। ইন্ডিয়াতে যেমন রোমিলা থাপার এর মেডিয়েভেল ইন্ডিয়া ও মডার্ন ইন্ডিয়া থেকে বিপান চন্দ্রের বইগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তেমনি করে বাংলার মধ্যযুগের ওপর ও এখানের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের কাজের ওপর বর্ণিত বিগত সময়ের প্রবন্ধগুলো হঠাৎ করেই পরিবর্তন করা হয়েছে। রোমিলা থাপারের লেখার প্রতি তাদের অভিযোগ ছিল তিনি মুসলমান শাসকদের প্রতি নরম থেকেছে এবং হিন্দুদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেনি। তারা নতুন বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকদের কমিটি থেকে বাইরে রেখেছে। কারা বই লিখবেন, কারা পর্যালোচনা করবেন তাও জানানো হয়নি। ভারতের এনসিইআরটি প্রণীত নতুন পাঠ্যক্রমে অত্যন্ত সুকৌশলে এমন বিকৃত ইতিহাস ঢোকানো হয়েছে। আমাদের ইতিহাস পাঠ্য বইয়ের ব্যাপারটিও অনুরূপ দেখতে পাই। ঠিক আমাদের পাঠ্যবইয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলার প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগের ধারাবাহিক বিবরণের পরিবর্তে সাদামাটাভাবে বিষয়গুলো আলাপ করা হয়েছে। যেন কোনো একটা নতুন বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সবার সঙ্গে উন্মুক্তভাবে বিষয়টি আলাপ করলে বাস্তবায়ন নাও হতে পারে ভেবে তড়িঘড়ি করে পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা হয়েছে।
ভারতের আরেকজন বুদ্ধিজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন বিজেপি পার্টি এখন এই আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করলেও এর শিকড় রয়ে গেছে অতীত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের শেষভাগে, যখন ব্রিটিশরা সযত্নে এই ধারণার লালনপালন করে গেছে। আরএসএস এর দীর্ঘদিনের যে একদফা কর্মসূচি, তার অন্যতম প্রকল্প হলো একদিকে সরকারি ভাষা হিসেবে সারা দেশে হিন্দিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এবং অহিন্দি ভাষী রাজ্যগুলির উপরে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়া। এর পাশাপাশি অখণ্ড ভারতকে মানুষের মাথায় সেটে দেওয়া। ইতোমধ্যে আমরা বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও ডিসলাইনে মাধ্যমে আকাশ-সংস্কৃতির ছোঁয়ায় দেখতে পাই আমাদের নতুন জেনারেশন তাঁরা খুব সহজেই হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। এখন যদি সেই সাথে এই ইতিহাস বইয়ের মাধ্যমে তাদের মাথায় ‘ভারতবর্ষে বাংলা অঞ্চল’ সেট করে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী দিনের আরএসএস সংঘের পরিকল্পনা যে বাংলাদেশে শতভাগ বাস্তবায়ন হতে চলছে সে আশঙ্কা না করার আর কি কারণ থাকতে পারে?
বরং আমাদের সিলেবাস জুড়ে থাকা দরকার আদিকাল থেকে বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যারা প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন যুগের দক্ষ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তাদের সমন্বয়ে এই পাঠ্যবই রচিত হলেই সেখানে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠত। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের যে গবেষকরা গবেষণা করছেন তার সারসংক্ষেপ আসতে পারত এই পাঠ্যবইয়ে। উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া প্রাচীন ধান জাপোনিকা নির্দেশ করছে, এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক মানুষের অভিবাসন ঘটেছিল পূর্বদিকের চায়না ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ থেকে। চট্টগ্রামে পাওয়া ব্রোঞ্জের মূর্তির ধরনও বলছে এখানকার সঙ্গে সেসব দেশের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগের কথা। লালমাই, ময়নামতি, চাকলাপুঞ্জি, ও পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার ও অন্যান্য অনেক প্রত্নবস্তুও উপরোক্ত ধারণার স্বপক্ষে প্রমাণ দিচ্ছে। সুতরাং আমাদের ‘ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলের’ ইতিহাস পড়া কিংবা অনুসন্ধানের চেয়ে আমাদের বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের অতীত ইতিহাস, সে ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করছেন সে গল্পগুলো শিক্ষার্থীদের জানালে তাহলেই সমৃদ্ধ হবে পরবর্তী প্রজন্ম, আমরাও হবো আশঙ্কামুক্ত।